নবীজির অপত্যস্নেহ ছিলো মুগ্ধকর। ভাবতেই ভালো লাগে, এমন এক পিতা ছিলেন তিনি, সন্তানের জন্য এমনই মমতায় ঘিরে থাকতো তাঁর হৃদয় যে, আমাদের মায়ায় জড়ানো এই সংসারী জীবন থেকে তাঁর জীবনকে খুব কাছের মনে হয়, নিবিড় মনে হয়। এত কাজের ভার, এত দায়িত্বের চাপ—তবু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্তানদের কথা ভুলে যেতেন না। তাঁর মনে তাঁর সন্তানেরা থেকে যেতো মায়ার এক ভুবন রচনা করে। তাঁর এই স্নেহ, এমন না যে, শুধু তাঁদের শিশুকালেই তা বিস্তৃত ছিলো; বরং যখন তাঁরা বড় হয়ে সংসার করছেন, তাঁদেরও আছে কোল-আলো-করা শিশু, তখনও তাঁদের প্রতি ছড়ানো ছিলো তাঁর বিস্তৃত মমতার ডালপালা।
সন্তানের কষ্ট তো দূর, সন্তান কষ্ট পাবে, এমন ভেবেও তিনি কাতর হয়ে উঠতেন; আবার সন্তানকে শিক্ষা দিতেন জীবনের ও আখেরাতের মধ্যকার সমান্তরালের কথাও। কোনটি গুরুত্বপূর্ণ, তা তিনি সন্তানদের সামনে স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন; এই ক্ষেত্রে ভাবেননি, সন্তানের চাহিদার দাবি; বরং গুরুত্ব দিয়েছেন সন্তানের কল্যাণচিন্তাকে। তাই তো একবার প্রিয় কন্যা ফাতেমার খাদেম চাওয়ার আবেদনকে নাকচ করে দিয়েছিলেন, প্রাধান্য দিয়েছিলেন তারচেয়ে উত্তম কাজকে। আবার ন্যায়-অন্যায়ের ব্যাপারে নিজের আপসহীনতার উদাহরণ দিয়েছিলেন এই কন্যাকে দিয়েই। এক মোকদ্দমায় সম্ভ্রান্ত বংশের কোনো মেয়ের হাত কাটার ফয়সালা হলে আসামীরা বংশের দোহাই দিয়ে তা হালকা করতে রাসূলের কাছে আবদার করে। রাসূল দৃঢ়ভাবে বলেন, আমার কন্যা ফাতেমা হলেও এই মীমাংসাই হতো। মোদ্দা হলো, মমতার অবারিত আকাশ আর ঔচিত্যের দৃঢ়তম সীমানা, সন্তানের ব্যাপারে সবটারই দেখভাল করেছেন আমাদের প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
ফাতেমা রা. এলেন নবীজির কাছে। বললেন, ‘আপনার সম্প্রদায় মনে করে, আপনার মেয়েদের কষ্ট হলেও আপনি ক্ষুদ্ধ হন না। এদিকে আলী আবু জেহেলের মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছে।’ শুনে নবীজি দাঁড়িয়ে গেলেন। আলী রা. আবু জেহেলের মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে ফাতেমা রা. সে খবর জেনে যান। আর সে খবর এসে নবীজিকে জানান। নবীজি মেয়ের কষ্টে ব্যথিত হন, মথিত কণ্ঠে বলেন, ‘আবুল আসের কাছে আমি মেয়ে দিয়েছি। সে আমাকে কথা দিয়েছে এবং কথা রেখেছে। ফাতেমা আমার কলিজার টুকরো। ওঁর কষ্ট আমি মেনে নিতে পারি না। কখনোই আল্লাহর নবীর মেয়ে আর আল্লাহর শত্রুর মেয়ে এক ব্যক্তির কাছে একত্র হতে পারে না।’ এসব শুনে আলী রা. তাঁর প্রস্তাব সরিয়ে নেন।
আপাতদৃষ্টে আলী রা. ও ফাতেমা রা.-এর সাংসারিক ব্যাপার হলেও ফাতেমা রা. যখন এই ব্যাপারে অভিযোগ নিয়ে আসেন, যখন এই ব্যাপারে তাঁর মনে জমে আছে অভিমান, তখন আল্লাহর রাসূল যেই সমাধান দিয়েছেন, তা শুধু মমতার প্রকাশই নয়, তাঁদের সাংসারিক জীবনের জন্য যা সুখময়, তার সমাধানও। কিন্তু এই ঘটনায় রাসূলের প্রতিক্রিয়া কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মতোই ভেঙে-পড়া ও মথিত, কন্যার আসন্ন পরিণতির ব্যাপারে সজাগ।
এই ব্যাপারে আরও একটি ঘটনা রয়েছে। একবার হিশাম ইবনে মুগীরা তার মেয়েকে আলী রা.-এর বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে রাসূলের কাছে অনুমতি চাইতে আসেন। রাসূল অনুমতি তো দিলেনই না, বরং তিনি স্পষ্ট বললেন, ‘অনুমতি দেবো না, দেবো না, দেবো না; আবু তালেবের ছেলের মন চাইলে আমার মেয়েকে তালাক দিক, তারপর বিয়ে করুক ইবনে মুগীরার মেয়েকে। ফাতেমা আমার কলিজার টুকরা। ফাতেমার মনে দ্বিধা চললে আমার মনও দ্বিধা জাগে। ফাতেমা কষ্ট পেলে আমিও কষ্ট পাবো।’
এই পর্যন্তই ঘটনা শেষ হতে পারতো। কিন্তু রাসূলুল্লাহ এই ঘটনাকে মিম্বর পর্যন্ত নিয়ে যান। সবার সামনে এই বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত জানান। মূলত এর সবই ছিলো একজন সন্তানের প্রতি পিতার কী কর্তব্য হবে, তা উম্মতকে বুঝিয়ে এবং শিখিয়ে দেওয়া; এবং এমন সংবেদনশীল এক ব্যাপারে রাসূলের মতো একজন প্রাজ্ঞ পিতার এই ভূমিকা একই সাথে কন্যাসন্তানের জীবনে পিতার মমতার সুগাঢ় প্রকাশ এবং নারীজীবনের নানামুখি সংকটকালীনতার এক সুমহান শিক্ষা।
ঘটনাসূত্র : সহীহ বুখারী।