পীড়িতদের জন্য একটি দুয়ার যে কত রকম করে অবারিত থাকতে পারে, নবী মুহাম্মদের দুয়ারে না-দাঁড়ালে তা বোঝা যায় না। এই আবার আরেকজন এলো;—ক্ষুধায় কাতর। থমথম করে উঠলো নবীজির মুখ। হৃদয়ের অতল বারির হৃদ ঘনভাবে যেন দুলে উঠলো। ঘরে-থাকা শেষ রুটির টুকরোটিও দিয়ে দিলেন। নিজেরা কী খাবেন, এই ভাবনায় কখনো বিচলিত দেখা যায়নি তাঁকে। তাঁর যত যাতনা ছিলো পরকে নিয়ে। পরই ছিলো তাঁর আপন। এমন ভুবনমোহন পরার্থপর তাঁর পর কেবল তিনিই। তিনি দয়ার নবী।
কখনো এমন সময় আসে, ঋণে-ঋণে জর্জরিত হয়ে থাকেন। সেও কি নিজের জন্য? কারও খাবার নাই, কারও নাই পথ্য; কারও ঘর নাই, কারও মাথা গুঁজবার ঠাঁইটুকু—সকলেই এসে দাঁড়াচ্ছে রহমতুল্লিল আলামিনের দুয়ারে। সম্বলহীনের শেষ অবলম্বন। তিনিও কাউকে ফিরাচ্ছেন না। দিতে-দিতে নিজে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। শেষ হয়ে আসছে সাথে-থাকা সাহাবীর থেকে নেওয়া ধারের পয়সাও; তবুও এই যে এখন দাঁড়ালো যে আর্ত, তাঁকে সেবা দেবে কে? তাকে কি বলে দেবেন, আর তো নেই কিছু। তা তো তিনি কখনোই বলেন না। তার পাশে গিয়েও দাঁড়াবে এই করুণার ছবি নূরনবী হযরত। এখন না-দিতে পারলেও বলে দেবেন, অমুক সময়ে এসো। খালিহাত বা খালিবুক ফিরে যাচ্ছে না কেউই। সকলেই জীবনের অতল তলানিতে খুঁজে পাচ্ছে একটু আশার মতো থই। নিরাশার হাহাতোলা ভূমিতে একটু যেন সবুজ হয়ে জাগছে অবিলম্ব দুঃখঘোচা তৃণ। আশায় বাসা বাঁধা সেই মানুষগুলোর চলার পথে তাকিয়ে থাকেন নবীজি। বুকের তলে ঝিরিঝিরি সুখের এক পলকা হাওয়া বয়ে যায়…
যায়েদ ইবনে সানার খুবই মেজাজ খারাপ। মুহাম্মদকে সে খুঁজছে : ভণ্ডামোর আর জায়গা নেই—ধারের টাকায় মানবসেবা! মুহাম্মদকে পেলে আজ সে দেখাবে, কাকে বলে ইবনে সানা। রোদের সাথে পাল্লা দিয়ে তার মেজাজ চরছে, অথচ মুহাম্মদের কোনো দেখা নেই—এমনই সময় মুহাম্মদকে দেখা গেলো;—ওই তো মুহাম্মদ…
‘অ্যাই মুহাম্মদ, তুমি পেয়েছোটা কী? টাকা নিতে তো ঠিকই মনে থাকে, দেওয়ার সময়ই যত টালবাহানা, না? আমি দেখাচ্ছি তোমার ভালোমানুষি। পরের টাকায় মানবসেবা—এএহ, এসেছে আমার দয়ার সাগর। খুব চেনা আছে তোমাদের। মুত্তালিব গোষ্ঠীর খাসলতই এই। ধার নিয়ে গড়িমসি। আমি এখান থেকে একচুল নড়ছি না। পয়সা নিয়ে তবেই তোমাকে ছাড়ছি।’—এইসব অপমানকর কথা বলে ইবনে সানা নবীজির পথ রোধ করলো। শক্ত মুঠিতে গায়ের চাদর টেনে ধরলো। জাতে ইহুদি ইবনে সানার উদ্ধত ভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে, নবীজিকে অপমান করাই আজ তার মতলব।
রেগে উঠলেন ওমর। এমন ধমক দিলেন, ইবনে সানার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। ভয়ে সে কুঁকড়ে গেলো। পালাবার যেন পথ খুঁজতে লাগলো। কিন্তু নবীজি ইবনে সানাকে দেখে বিমর্ষ হলেন। আদরমাখা মুখ করে ওমরের দিকে চাইলেন; বললেন, ‘ওমর, ইবনে সানার কি এ আচরণ প্রাপ্য ছিলো? আমাকে ওর প্রাপ্য ফিরিয়ে দেওয়া আর ওকে সুন্দরভাবে তাগাদা দেওয়ার উপদেশই কি আমাদের জন্য শ্রেয় আচরণ ছিলো না?’ নবীজির কথা শুনে ওমর আর ইবনে সানার রা সরছে না। বিমূঢ় হয়ে তাঁরা তাকিয়ে আছে এ কার দিকে…
‘নবুওতের সব প্রমাণ তো আমি তাঁর মধ্যে পেয়েছিলাম। বাকি দেখার ছিলো একটি গুণ;—আমি জানতে পেরেছিলাম, শেষ যে নবী, তাঁর ধৈর্য এতই হবে যে, তা মানুষের মূর্খতাকে ছাড়িয়ে যাবে। লোকে যতই মূর্খ আচরণ করুক না কেন, তাঁর ধৈর্য তাতে টলবে না; বরঞ্চ আরও বেড়ে যাবে। তাই, এই গুণ দেখার ইচ্ছা নিয়ে ধার পরিশোধের নির্ধারিত দিনের আগেই আমি এই নাটক সাজিয়েছিলাম এবং দেখেছিলাম, কী বিরলতম রূপেই না তিনি নবুওতের প্রমাণ বয়ে বেড়াচ্ছেন!
আসলেই তাঁর মধ্যে ধৈর্যের এমন আশ্চর্য এক সমাবেশ ঘটেছিলো, যা দেখে কেবল অবাকই হতে হতো। তিনি সেই সময়েই সম্পূর্ণ ধার তো পরিশোধ করলেনই, সাথে ওমরকে ধমক দেওয়ার কারণে বললেন, আরও কিছু বেশি খাদ্য দিয়ে দিতে…’—যায়েদ ইবনে সানা যখন মুসলিম হন, তখন তিনি এইভাবে সেদিনকার সেই ঘটনার রহস্য ফাঁস করেন।
ঘটনা ও সূত্র : হাকেম ফিল মুসতাদরাক।