আল্লাতে যার পূর্ণ ঈমান

সেই যে নবীজি এসেছিলেন মদীনায়, সেই দিন থেকে একদিন তাঁর স্থিরতা নেই। রাজ্যের সব কাজের ভার তাঁর উপরেই। ভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় দূত থেকে নিয়ে ধর্মীয় দূতের সাথে কথার মতো কূটনৈতিক প্রসঙ্গ, আবার মদীনার ধুলোয় দৌড়ে বেড়ানো ছোট্ট বালকের মন ভালো করে দেওয়ার মতো নিতান্ত সাধারণ ব্যাপার—সবকিছু নিমিষে সমাধান করে দেওয়ার জাদুকাঠি তাঁর অদৃশ্য ঝোলায় পোরা। চতুর্মুখী এত সব ব্যস্ততার পর যে মদীনাতেই থাকতে পারছেন সর্বক্ষণ, তাও নয়; রাজ্যের সর্বাধিনায়ক হয়েও ছুটে বেড়াচ্ছেন ষড়যন্ত্রমুখর কোনো গোষ্ঠীর মোকাবেলায়।

এমনই এক ঘটনা ঘটলো তৃতীয় হিজরীতে। দাসুর নামের এক পার্শ্ববর্তী আরবনেতা তার বাহিনী নিয়ে মদীনায় আক্রমণ করার ষড়যন্ত্রে উন্মত্ত—সদলবলে এগোচ্ছিলো মদীনার দিকে। নবীজি নিজেই বাহিনী নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। ষড়যন্ত্রীর গোপন জিঘাংসা নষ্ট করে দিতে এগিয়ে গেলেন মদীনার বাইরে, যেখানে শত্রুবাহিনী ঘাঁটি গেড়ে আছে। অসামান্য নৈপুণ্যে ধাওয়া করলেন শত্রুর বাহিনীকে। দাসুর তার সেনা-সামন্তসহ পালিয়ে গেলো। কিন্তু পালিয়ে গেলো কি?…

দুশমন পালিয়েছে নিশ্চিত সাহাবীরা এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তার ওপর এক পশলা বৃষ্টিও হয়ে গেলো। ভেজা কাপড়চোপড় শুকোনোর ও বিশ্রামের উদ্যোগ নেওয়া হলো। নবীজিও পরিশ্রান্ত। তিনি এক গাছের ছায়ায় বসলেন। তন্দ্রায় ভরে এলো তাঁর চোখ। তারপর গভীর নিদ্রা। কিন্তু তিনি জানেন না, দুটি আততায়ী চোখ তাঁকে অনেকক্ষণ ধরে অনুসরণ করছে। সাহাবীরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত। কেউ এদিকে মনোযোগী নয়। গুপ্তচর চোখটি ভাবলো, এই তো সুযোগ…

সবার চোখ এড়িয়ে, বিস্তর দুস্তর পেড়িয়ে পা টিপে-টিপে আততায়ী গিয়ে দাঁড়ালো সেই গাছটির পাশে। নবীজি এখনও ঘুমোচ্ছেন। গভীর তাঁর ঘুম। ক্লান্ত ঘুম যেমন গাঢ় হয়, এই ঘুম তা-ই। আততায়ী কোষ থেকে তরবারি বের করলো। এমন অব্যর্থ মুহূর্ত আর আসবে না কোনো দিন। ধরার পিঠ থেকে মুহাম্মদকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার এ-ই মোক্ষম সময়। কোপ দিয়ে ধড় থেকে মুহাম্মদের মাথা আলাদা করে ফেলবে, এমন সময় আততায়ী—আসলে তো সে দাসুর—ভাবলো, এত যে মুহাম্মদ ‘আল্লাহ-আল্লাহ’ করে বেড়ায়, এই জীবননাশের মুহূর্তে বোঝা যাক আল্লাহর বাহাদুরি…

সে হাঁক ছাড়লো, ‘কী হে, মুহাম্মদ; বেঘোরে ঘুমোচ্ছো? চির ঘুম তো ঘুমালে বলে।’

নবীজি কিছুই হয়নি যেন, এমন করে চোখ মুদলেন; দেখলেন, খাপখোলা তরবারি হাতে দাসুর তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। মুখে তাঁর ঘোড়েল হাসি। যেন সে খুব মজা পাচ্ছে। তিনি সপ্রশ্ন দাসুরের দিকে চাইলেন। দাসুর খাঁচায় আটকে পড়া পাখির প্রতি যে কৌতুক, সেই কৌতুক নিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কী মুহাম্মদ, আমার এই খোলা তরবারির ধার থেকে কে বাঁচাবে তোমাকে এই নির্জন জায়গায়?’ নবীজি দাসুরের কথায় চুপ করে রইলেন। খানিক চুপ থেকে যেন কোনো ভাবান্তর হলো না, বললেন, ‘আমার আল্লাহ।’ কে জানে, সেই মন্দ্র কণ্ঠে কী ছিলো—জাদু, মোহ নাকি ভয়ার্ত ইন্দ্রজাল—দাসুরের হাত থেকে তরবারি খসে পড়লো—যেন সে তা টেরই পেলো না, এমনভাবে। আসলে এ তো ছিলো আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ঈমানের অবিশ্বাস্য অবিচলতার ঘোর।

রাসূল দেরি করলেন না। খসে-পড়া তরবারি সাথে-সাথে হাতে নিয়ে দাসুরের গলায় ধরলেন। মুহূর্তে পাশার দান উল্টে গেলো। দাসুরের যেন সম্বিৎ ফিরে এলো। ঘটনার আকস্মিকতায় সে এতটাই বিমূঢ় হয়ে পড়লো যে, ভাষা হারিয়ে ফেললো। অসহায়ত্ব আর ভয়, অক্ষমতা আর আচমকা ঝটিতিতে সে শূন্য হয়ে রইলো। নবীজি জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলো তোমাকে কে বাঁচাবে?’

দাসুরের বিশ্বাস নেই সেই খোদায়, যেই খোদা হাতের বাইর থেকে হাত চালান। নবী মুহাম্মদের জবাব জানা সত্ত্বেও জীবনের বিশ্বাসেই সে শব্দ করে উঠলো; বললো, ‘কেউই নেই।’ নবীজির খুব মায়া হলো। তিনি বললেন, ‘না, দাসুর; আমাদের কারও হাতেই জীবন-মরণ নয়; জীবন-মরণ তো বাঁধা সাত আকাশের ওপারে যে রবের আরশ, সেই আরশের মালিকের।’ অচিন্ত্যনীয় সেই আরশের সীমানায় হারিয়ে গেলো দাসুরের সীমিত সসীম দৃষ্টি…

ঘটনা ও সূত্র : সীরাতে ইবনে হিশাম, আবু মুহাম্মদ আবদুল মালেক ইবনে হিশাম।