ইবাদতে ও কাজবাজে মধ্যমপন্থী রাসূল

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ইবাদতগুজার বান্দা ছিলেন। একবার কৌতূহলী সাহাবীদের তিনজনের একটি দল রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের কাছে গিয়ে নবীজির ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো। নবী-পত্নীগণ যখন রাসূলের ইবাদত সম্পর্কে তাদের জানালেন, তখন তাদের কাছে রাসূলের ইবাদতের পরিমাণ খুব কম মনে হলো। তারা বললো, আমাদের থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত ঊর্ধ্বে, আল্লাহ তাঁর আগে-পরের সব গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। যেন তারা ধরে নিলো, যেহেতু আল্লাহর রাসূলকে মাফ করে দেওয়া হয়েছে, তাই তাঁকে বেশি ইবাদত করতে হবে না; কিন্তু তাদের জন্য যেহেতু আগাম ক্ষমার অঙ্গীকার নেই, তাই তাদের বেশি ইবাদত করতে হবে। যখন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা জানতে পারলেন, তখন তিনি বললেন, তোমরা কি এমন এমন বলেছো? তাহলে শুনে রাখো, আমি তোমাদের থেকে আল্লাহকে বেশি ভয় করি। কিন্তু আমি রোযা রাখি, ইফতারও করি। নামায পড়ি, ঘুমাইও। বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হই। এসব আমার সুন্নাত। যে আমার সুন্নাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সে আমার উম্মত নয়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবাদত, তাকওয়া, আখলাক, মুয়ামালাত-মুয়াশারাত, যুদ্ধপারদর্শিতা, নেতৃত্বদান, প্রেমময়তা, স্নেহ, ধৈর্য—মোটকথা মানবিক গুণাবলির যেসব কথা আমরা ভাবতে পারি বা না-পারি, তার সব গুণাবলি রাসূলের থাকা সত্ত্বেও তিনি সবকিছুতে এক সুনিপুণ সমন্বয় সাধন করে নিজেকে করেছিলেন এক মধ্যমপন্থী মানুষ। তিনি পছন্দ করতেন মধ্যমপন্থা। আলোচ্য হাদীসটিতে তিনি সে কথাই সাহাবীদেরকে বোঝাতে চেয়েছেন। ইসলামে আল্লাহর সাধনা মানে বৈরাগ্যবাদ নয়। ইসলামে বৈরাগ্যবাদের জায়গা নেই। একটি সুস্থ সুন্দর মানবিক জীবন কাটানোই ইসলামের শিক্ষা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি তা-ই ছিলেন। তিনি তাঁর সকল গুণাবলিতে সমন্বয় সাধন করতে পেরেছিলেন বলেই, মধ্যমপন্থী হতে পেরেছেন বলেই মানব-গুণাবলির যেখানেই তাকানো হয়, দেখা যায়, শ্রেষ্ঠ গুণের আসনটি তাঁর মহিমায় অলঙ্কৃত হয়ে আছে।

আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কস্মিনকালেও তোমাদের মধ্যে কেউ আমল দিয়ে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে না। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনিও না? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, আমিও না। তবে আল্লাহ তায়ালা যদি আমাকে আপন রহমতের চাদরে ঢেকে নেন, আলাদা কথা। তোমরা মধ্যপন্থা অবলম্বন করো। সকাল বিকাল এবং রাতের কিছু অংশে আল্লাহর ইবাদত করো। আর আঁকড়ে ধরো মধ্যমপন্থাকে, তাহলে তোমরা গন্তব্যে পৌঁছুতে পারবে।

আয়েশা রা. বলেন, একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি আমার কাছে এলেন। তখন এক নারী আমার কাছে বসা ছিলো। রাসূল জিজ্ঞেস করলেন, ইনি কে? আমি বললাম, উনি অমুক। তার অধিক নামাযের কথা মানুষ বলাবলি করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, থামো, তোমাদের যতটুকু সামর্থ্য, ততটুকুই করা উচিত। আল্লাহর শপথ, আল্লাহ তায়ালা ক্লান্ত হবেন না। তোমরাই ক্লান্ত হয়ে পড়বে।

আনাস রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন যায়নাব রা.-এর ঘরে প্রবেশ করে দেখলেন, দুই খাটের মাঝখানে একটি রশি বাঁধা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এই রশিটি কীসের জন্য? অন্য স্ত্রীরা বললেন, এটা যায়নাবের রশি। তিনি ইবাদত করতে-করতে ক্লান্ত হয়ে গেলে নিজেকে এ রশির সাথে বেঁধে নেন। তিনি বললেন, এটা খুলে ফেলো। তোমাদের যে কোনো ব্যক্তির উদ্যম থাকা পর্যন্ত ইবাদত করা উচিত। যখন ক্লান্ত হয়ে যায়, তখন যেন সে পড়ে।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন কাজ করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করতেন, যা নিয়মিত করা হয়, যদিও অল্প। এ সম্পর্কে অনেক হাদীসও বর্ণিত হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল হলো, যা সর্বদা করা হয়, যদি তা পরিমাণে অল্পও হয়।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবাদতসহ সকল কাজে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করতেন। যা মানুষের আয়াসসাধ্য, যা করতে স্বাভাবিকতার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি হয় না, সবকিছুতেই রাসূল সেদিকে খেয়াল রাখতেন।

ঘটনা ও সূত্র : বুখারী, মুসলিম।