আল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কুরআনে বলেছেন, ‘যে মুমিন বান্দারা আপনার সাথে আছে, তাঁদের জন্য আপনার ডানা নত করে দাও।’ আল্লাহর এই আদেশ রাসূলের জীবনে কীভাবে যে ফলেছিলো, তা রাসূলের জীবনে প্রবেশ না-করলে বোঝা যায় না। এমন বিনয়ের আকাশ ছিলেন তিনি, এমন নম্রতার স্নিগ্ধবহ ছায়া—যে, মনে হয়, এত কীভাবে ভালো ছিলেন লোকটা—এত আলো-আলো কেন? ভালোলাগার এক সীমানাহীন সীমায় দাঁড় করিয়ে এরকম অক্ষম আর এলোমেলো করে ফেলেন আমাদেরকে—এমনই নম্র ভদ্র বিনয়ী আর সুন্দর ছিলেন তিনি।
তিনি ছিলেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)—আল্লাহর পয়গম্বর, নবী—নবুওতের ধারক, তিনি ছিলেন মুরসাল—রেসালাতের হরকরা; কিন্তু কোনো দাপুটে রাজ্যনেতা ছিলেন না তিনি, তিনি ছিলেন শিক্ষক ও বন্ধু, তিনি ছিলেন দরদি এক মানুষ—যাঁর কাছে আল্লাহ ওহি পাঠাতেন; যদ্যপি মদীনার ভার তাঁর হাতে ছিলো, কিন্তু কোনো অচেনা আগন্তুক সাহাবীদের মধ্যে থেকে তাঁকে আলাদা করতে পারতেন না, এতটাই নিবিড়ভাবে মিশতেন তিনি সাহাবীদের সাথে। এমনকি জিজ্ঞেস করে জানতে হতো, তোমাদের মধ্যে মুহাম্মদ কে?
আবদুল্লাহ ইবনে আমর নামের এক সাহাবী বলেন, ‘একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে এলেন। তিনি যেন আরাম করে বসতে পারেন, সেজন্য আমি তাঁকে ছালভর্তি একটি চামড়ার বালিশ দিলাম। কিন্তু তিনি মাটিতেই বসে গেলেন।’ সাহাবী আরও বলছেন, ‘বালিশটি তাঁর ও আমার মাঝে পড়ে থাকলো।’ কী অপূর্ব মানুষ। কী ক্ষমাহীন ভালোবাসায় বেঁধে ফেলতে পারতেন তিনি…
নবীজির বিখ্যাত সহচর ও খাদেম মহাত্মা আনাস রা. বলেন, ‘এক নারীর সামান্য মাথার সমস্যা ছিলো। সে একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এসে বললো, হে আল্লাহর রাসূল, আপনার কাছে আমার একটি প্রয়োজন আছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, অমুকের মা, কোন পথে যেতে চাও, বলো; আমি তোমার প্রয়োজন মেটাবো। এরপর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে কোনো এক রাস্তায় গেলেন এবং তার কথা শুনলেন।’
এই আনাস রা. আরও একটি ঘটনা বলেন। একবার নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজে গেলেন। তিনি আরোহণ করছিলেন এমন একটি উঠের পিঠে, বয়সের ভারে যে কুঁজো হয়ে ছিলো। তাঁর গায়ের চাদরের মূল্য চার দিরহাম বা তারও কম মূল্যের ছিলো। তখন তিনি আল্লাহকে উদ্দেশ করে বলছিলেন, হে আল্লাহ, এই হজ কাউকে দেখানো বা শোনানোর জন্য নয়। আনাস রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে উটে সওয়ার হয়ে ছিলেন, তা ছিলো তাঁর খাদ্য ও মালবহনকারী উট। তখন এই একটি উট ছাড়া আর কোনো উট ছিলো না নবীজির।
আনাস রা. রাসূলকে অনেককাল ধরে একনাগাড়ে দেখেছেন। দেখেছেন তাঁর দিন-রাত, সকাল-সন্ধ্যা, আহার-বিহার, সঙ্গ ও নিঃসঙ্গতা। কী এক দেখার ভাগ্য ছিলো আনাস রা.-এর, ভাবলেই তাঁর ভাগ্যকে ছুঁয়ে দেখতে মন চায়—অন্তত একবার। কিন্তু হায়, ভাগ্য তো ছোঁয়া যায় না। ছুঁতে পারতে হয় সেই সময়, সেই মানুষের জীবন, সেই সৌভাগ্যের ভাগ জীবনে চেয়ে নিতে হয়। এই যে কত ভাগ্যবান সাহাবী আনাস, এই যে পৃথিবীভরা মানুষকে ঈর্ষায় ভরিয়ে-তোলা আনাস লোকটা, তিনি নবীজিকে নিয়ে কত কী যে বলেছেন; বলেছেন তা-ই, যা তিনি দেখেছেন; বলেছেন অনেক-অনেক ভালোবাসা আর হিম-শীতল এক ভয় বুকে চেপে; কারণ, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে আমার নামে স্বেচ্ছায় মিথ্যা বলবে, সে জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেবে। তিনি নবীজির এই কথার বরাত টেনে বলেছেন, এই কথা আমাকে অনেক হাদীস বর্ণনা করতে দেয়নি।
কিন্তু তাও আনাস রা. বলেন, কেউ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কানে-কানে কথা বললে তিনি ততক্ষণ কান সরাতেন না, যতক্ষণ না ব্যক্তির কথা শেষ হতো। ততক্ষণ ছাড়তেন না ধরে-রাখা হাত, যতক্ষণ অপর ব্যক্তি তা না ছাড়তো।
আর আবু মাসউদ রা. বলেন, ‘একবার কোনো লোক রাসূলের সামনে কথা বলতে গিয়ে খুব কাঁপছিলো। তিনি লোকটিকে অভয় দিয়ে বললেন, শান্ত হও, আমি কোনো বাদশা নই; আমি এমন মায়ের ছেলে, যে মা শুকনো গোশতের টুকরো খেয়ে জীবন ধারণ করতেন।’
বিনয়ের এমনই সরল বিহ্বল-করে-দেওয়া প্রতিরূপ ছিলেন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
ঘটনাসূত্র : বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাজা