এ কোন ক্ষমা

সারা মদীনায় খুশির নাকারা বাজছে। বাচ্চারা আনন্দে হল্লা দিচ্ছে। জেনানারা কেউ বেরিয়ে পড়েছে ঘর থেকে। কেউ কিছুটা আড়াল করে দাঁড়িয়েছে,—মুখে তৃপ্তির ছাপ। এক আনন্দের হিল্লোল সবাইকে মুখর করে তুলেছে। তরুণরা আগেই চলে গেছে শহর থেকে একটু আগ বেড়ে। প্রবীণরা অভ্যর্থনায় শান্ত গাম্ভীর্য ধরে রেখেছে। পুরো ইয়াসরিবের আজ অন্যরকম প্রকৃতি, অন্যরকম আবহাওয়া। হিজরতের দুস্তর পথ শেষ করে আজকে নবীজি ইয়াসরিবে পদার্পণ করবেন—এই তিনি এলেন বলে। শোনা গেছে, এক শুভ্র কাফেলার আভাস দূর থেকে নাকি দেখা গেছে। অপেক্ষার চাপা আনন্দ তাই সুবাস হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। কিন্তু একটি চেহারা মনমরা। বিমর্ষ মুখে সে বসে আছে। কপালে তার চিন্তার কুটিল ছাপ। এই সর্বজনীন আনন্দে সে খুশি হতে পারছে না।

ইয়াসরিবে যখন ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ তুঙ্গে, কোনোভাবেই সামলানো যাচ্ছে না একেকটি সংঘর্ষ, অথচ জান-মাল শেষ হয়ে নিঃস্বপ্রায় অবস্থা সবার; এদিকে ইহুদিদের সুদি মুনাফালোভী চক্রবৃদ্ধির ছোবল থামছেই না, শুধু বাড়ছে; তখন ইয়াসরিববাসী, মক্কায় এক নতুন ধর্মের দাঈর ব্যাপারে শুনছে। হজে বা ব্যবসার প্রয়োজনে মক্কায় গিয়ে দেখেও আসা হয়েছে নানা কিছু। সব মিলিয়ে সবাই যেন মনে-মনে একটা ভরসার জায়গা খুঁজে পেলো। সবশেষে উপত্যকার দুইটি বাইয়াত সবার মনের সুপ্ত ইচ্ছার এক বাস্তবিক রূপ পরিগ্রহ করলো। কিন্তু এখানেও ব্যক্তিস্বার্থবাদী এক লোক শুধুই ঘোঁট পাকাচ্ছিলো। নেতৃত্বের স্বপ্নে বিভোর আবদুল্লাহ ইবনে উবাই কিছুতেই এই নতুন নেতার আগমন মানতে পারছিলো না।
নবী-আগমনের প্রথম কাল থেকেই সেই যে কূটচালে ভরে উঠেছিলো আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর মন, আর কখনো হালকা হতে পারেনি এই দুর্বহ নষ্ট গলিজ থেকে। চেয়েছিলো কি? কিন্তু না-চাইলেও কি মরণ আসে না মানুষের? ইবনে উবাইরও এলো। সে একদিন মরে গেলো।

যারা চিনতেন ইবনে উবাইকে, কোথাও আটকে থাকা এক অসহ্য বিব্রতি যেন ইবনে উবাইর মৃত্যু বেয়ে নেমে গেলো। এই তো সেই ইবনে উবাই, যে উম্মুল মুমিনীন আয়েশার গায়ে লাগাতে চেয়েছিলো কলঙ্ক; এই তো সেই খল চেহারার ইবনে উবাই, যে উহুদের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতায় মুসলিমদের সঙ্গ ছেড়ে এসেছিলো মাঝপথেই; এই তো বহুরূপী সেই ইবনে উবাই, যে রাত-দিন এক করে ইহুদিদের সাথে ষড়যন্ত্র করেছিলো নবীজির বিরুদ্ধে, বানিয়েছিলো মসজিদে জিরার, এমনকি নবীজিকে মদীনা থেকে তাড়ানোর হুমকি দিয়েছিলো। এত সব অন্যায় আর নির্লজ্জ বিশ্বাসঘাতকতার অমোচ্য কালিঝুলি মেখে শুয়ে আছে ইবনে উবাই। কে পড়াবে এই নরাধমের জানাজা? কার পড়াতে মন চাইবে? স্মৃতি কি দু হাতে বাধা দিয়ে বলবে না, ইবনে উবাইর জানাজা, কখনোই না…

ওমরের নিজেকে পাগল-পাগল লাগছে। এগুলো কী করছেন রাসূল? তিনি দেখি ইবনে উবাইর জানাজা পড়াতে এগোচ্ছেন। যেন তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে না, যেন তিনি ভুল দেখছেন, যেন রাসূল খেয়াল করেননি—এ ইবনে উবাই, এমন করে ওমর বললেন, ‘আপনি ইবনে উবাইর জানাজা পড়াবেন? আপনি কি বুঝতে পারছেন—ইবনে উবাই? ভুলে গেছেন সব? কিছুই কি আপনার মনে পড়ছে না?—মদীনার প্রথম দিন, উহুদের প্রান্তর, আয়েশার অপমান, মসজিদে জিরার কিবা বনী মুস্তালিকের ঘটনার ইবনে উবাই—কিছুই কি মনে পড়ছে না? রাসূল ওমরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন—রহস্যময় সে হাসি; এই হাসি ওমরকে ভারাক্রান্ত করেছে চিরদিন। ওমর জানে, এই হাসির পিছনে ক্ষমার এমন খরস্রোতা ধারা, যে ধারায় ওমর বিহ্বলই হয়েছে চিরকাল; তবু ওমরের মন মানে না। অপরাধীও পেতে পারে এমন ক্ষমা, কিন্তু নাছোড় সীমালঙ্ঘী কেন পাবে এ ধারার খোঁজ—ওমরের ন্যায়পরায়ণ মন রাসূলের চাদর টেনে ধরে পেছন থেকে; চোখের ভাষায় বলে, না, আপনি পড়াবেন না ওর জানাজা—চোখে টলটল করে ব্যথা ও রাগের অক্ষম যুগপৎ আঁসু। দয়ার নবী চেনেন এ ওমরকে। এর সবই ওমরের দু কূল-ছাপা ভালোবাসার প্লাবন, যা তাঁকে দিয়ে দেয় নবীর চাদর টেনে ধরারও আস্পর্ধা। নবীজি আবারও হাসেন মৃদু করে। হয়তো ওমরের এই উচিতভরা ভালোবাসায় প্লাবিত হন তিনিও। কিন্তু তবু, আরও শান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘ওমর, যদি জানতাম,—সত্তরবারও যদি হতো —ওর হয়ে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ রেহাই দেবেন ওকে; তবে আমি তা-ই করতাম।’

রাসূলের জীবনের শব্দে বারবার পাড়ভাঙা ওমরের জীবনের নদী আরও-আরও বড় হয়, আরও-আরও খাঁটি হয়। পেছনে তো আরও দাঁড়িয়ে আবেগ-বিহ্বল আর-সাহাবাদের দলও…

ঘটনা ও সূত্র : তাফসীরে মাআরেফুল কোরআন, মুফতী শফী।