এ পৃথিবী একবার পায় তারে…

আসলে ওদের সমস্যা মুহাম্মদে নয়, ওদের সমস্যা, মাথাব্যথা, গা-জ্বালার বিষয় মুহাম্মদের প্রচারিত ধর্মমত। ওদের সমস্যা নিজেদের মিথ্যা আর অলীক অন্ধবিশ্বাস নুয়ে পড়ায়। না-হলে কেন মক্কা থেকে বিতাড়িত করার পরও, যখন মুহাম্মদ আর তাঁর ধর্মের প্রচার নিয়ে তাদের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন না, তখনও তারা মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলার ছক আঁকে? মদীনা গিয়েও স্বস্তি হয় না মুসলিমদের। কাফেররা স্বস্তিতে থাকতে দেয় না। চারপাশ থেকে শুধু ধ্বংস করে ফেলার নির্মম ষড়যন্ত্র। সেইসব ষড়যন্ত্র ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে দেয়ালে এখন পিঠ ঠেকেছে। এসেছে পাল্টা জবাব দেওয়ার পালাও।

বদর প্রান্তর। অনেক ছক কষে, অনেক হিসাব-নিকাশ শেষে বিরোধ আজকে যুদ্ধের ময়দানে এসে দাঁড়িয়ে। ধনুকে তির লাগার মতো টানটান পরিস্থিতি। আরব-কোরেশরা বিশাল লস্কর নিয়ে খুশির ডগমা বাজাচ্ছে। যুদ্ধ নয়, যেনবা হেসে খেলে কিছু পিঁপড়েকে পিষে যেতে এসেছে তারা। শুধু দেখতে মানুষের মতো বলে আর ময়দান যুদ্ধের বলে একটা সাজসাজ ব্যাপার নেওয়া। মুসলিমরা বিপর্যস্ত রুগ্ণ ক্লিশে আর সংখ্যায়ও গুটিকয়। কী হবে তাঁরা জানে না। কিন্তু কী এক অমোঘ টান তাঁদের এখানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। শুধু কি যুদ্ধপারঙ্গম মুসলিমরাই এসেছে?—না; বরং যুদ্ধ জানে না, নেই অস্ত্রও, না যেন কোন অদৃশ্যের পাটাতনে দাঁড়িয়ে হাতে শুধু খেজুরডাল, সেও উপস্থিত, যুদ্ধ করবে!

রাসূলের কপালে চিন্তার রেখা। বারবার তিনি আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন। খোদার আরশ থেকে কোন ফয়সালা নেমে আসে, সেদিকেই তাঁর মন। যুদ্ধ, লড়াই, আদায় করে নেওয়া—এগুলো তো নিমিত্তমাত্র। নিমিত্ত নিয়ে তিনি ভাবছেন না। নিমিত্তের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ কেবলই নিয়মের বিচারে। নতুবা তাঁর জীবন তো ওই সাত আকাশের ওপারে এক মহান নিয়ন্তার সাথে বাঁধা।

নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই অঙ্গুলিমেয় মুসলিম-কাফেলার সালার। ঢাল-তলোয়ার প্রায় কিচ্ছু নেই। তিনশো তেরোর একটি দলে ঘোড়ার সম্বল শুধু একটি। তলোয়ার—সেও অধিক ভাঙা। যতই আকাশের সুসংবাদ থাকুক, কিন্তু তাওয়াক্কুল তো চেষ্টাহীনতা বা উদ্যোগের মতো অকর্মণ্য কোনো স্বপ্নবিভোর ভাবালুতাভরা বিষয় নয়; বরং তাওয়াক্কুলের মানেই হলো, যথাসাধ্য চেষ্টার উদ্যোগ গ্রহণ করা। সে কারণেই নবীজি বিচলিত। সময়ে-সময়ে মনে হচ্ছে, চেষ্টায় কোনো খামতি রয়ে যায়নি তো?—সব ঠিক আছে তো?—আল্লাহর সন্তুষ্টি সাথে থাকবে তো? আশা-আশঙ্কার গলাগলি নিয়ে রাসূল লুটিয়ে পড়ছেন সেজদায়। তাঁর চোখ ধেয়ে নামছে নুসরতপ্রার্থী অশ্রুর ঢল। মিনতিভরে বলছেন, ‘এঁরা তোমার গুটিকয় বান্দা; তোমার নামে জীবন বিলানোর আর কেউ নেই, নেই তোমার নাম ডাকার মতো কেউও; এঁদের তুমি বিফল কোরো না। তোমার ওয়াদা তুমি পূরণ করো। এঁরা বিফল হলে এই ধরাধাম থেকে তোমাকে ‘আল্লাহ’ বলে ডাকার লোকেরা হারিয়ে যাবে…’

হুজাইফা ইবনে ইয়ামান নামে এক সাহাবী। মক্কা আর মদীনায় তাঁর বিস্তর আসা-যাওয়া। এখন তিনি আছেন মক্কায়। ওদিকে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। মুসলিমদের সহায়সম্বলহীনতার কথা তাঁর অজানা নয়; তদুপরি তিনি অসীম সাহসী যোদ্ধা। এমন অসহায়ঘন অবস্থায় মুসলিম-শিবিরে তাঁর উপস্থিতি খুবই জরুরি ব্যাপার; তাছাড়া ইসলামের পক্ষে প্রথম লড়াইয়ের আশা কোন লড়াকু বীর হেলায় ছেড়ে দেয়। তিনি গোপনে বদর অভিমুখী হলেন। ওখানেই ছাউনি ফেলেছে আল্লাহর দুশমন কোরেশরা; আর প্রতিরোধে বিপর্যস্ত ভগ্নদশা মুষ্টিমেয় মুসলিম-জামাত। চলছেন রণাঙ্গনসংক্রান্ত নানা জল্পনা-কল্পনাকে উদ্দাম ছেড়ে দিয়ে। খেয়াল করেছেন কি করেননি, দেখলেন, মক্কার আরবরা তাঁর পথ রোধ করে রেখেছে।

হুজাইফা ইবনে ইয়ামান অনেক বুঝিয়ে ছাড়া পেলো। তবে, মুসলিমদের সাথে এ যুদ্ধে সে অংশগ্রহণ করবে না, এমন কথা দিয়েই মুক্তি মিলেছে । মনে সে ইচ্ছে নেই, তবু সে অঙ্গীকার করেই মুক্ত হলেন সাহাবী হুজাইফা ইবনে ইয়ামান। রণাঙ্গনে সোজা রাসূলের সামনে দাঁড়ালেন। বললেন বিস্তারিত সব কিছু। সাথে ঘোষণা করলেন যুদ্ধে যোগ দেবার প্রত্যয়…

রাসূলের খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু তাঁর আলামত তাঁর চেহারায় ফুটে উঠছে না। বরং তিনি কোথায় যেন হারিয়ে গেছেন। দূরমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবছেন। সেই ভাবনা থেকে যখন ফিরে এলেন, তখন তিনি খুব শান্ত শমিত আর স্থির; সেই আবহ কণ্ঠে ধরে রেখে বললেন, ‘মুসলিম ওয়াদা ভঙ্গ করতে পারে না।’

হুজাইফা ইবনে ইয়ামান মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি একজন কুশলী যোদ্ধা। যুদ্ধের অনেক রীতি তাঁর জানা। কিন্তু এইমাত্র তাঁদের সালার, তাঁদের পয়গম্বর যিনি, তিনি যে কথা বললেন, যেই নির্দেশ শোনালেন, এমন অস্থির দুর্যোগ অনটনকালীন পর্বে, এরকমের সালারের কথা রূপকথায়ও তিনি শোনেননি, এমন সালার তিনি এই প্রথম দেখলেন, আর কখনো দেখবেন না…

ঘটনা ও সূত্র : সহীহ মুসলিম।