ঘর-সংসারের যেসব কাজে ইসলামের লঙ্ঘন নেই, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সব করতেন। পয়গম্বর ছিলেন বলে নবুওতের গুরুভার তাঁর সংসার-জীবনকে কোণঠাসা করে তোলেনি; বরং তাঁর সংসার ছিলো হাসি-আনন্দে ঠাসা এক মায়াময় সংসার। তাঁর সংসার-জীবনে আমাদের জীবন সুখী হয়ে ওঠার এমন-সব উপাদান রয়েছে যে, একজন নবী না যেন কেমন হবে, এমন ভেবে এবং তাঁর জীবনের পাঠ থেকে দূরে সরে আমাদের সেসব সম্পর্কে জানাই হয়ে ওঠেনি। অথচ তাঁর জীবনও আমাদের মনে লুকিয়ে-থাকা মানবিক আনন্দের সাথে খুবই সঙ্গতিপূর্ণ এক জীবন।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্ত্রীদের সাথে পর্যাপ্ত হাসি-কৌতুক করতেন। স্ত্রীদের শখ-আহ্লাদের ব্যাপারেও তাঁর মনের সায় ছিলো। তিনি সেসব শখ-আহ্লাদে বাধা তো দিতেনই না, কখনো নিজেই এসবের অংশ হয়ে যেতেন।
একবার হযরত হানযালা রা. অভিযোগ করলেন, স্ত্রী আর সন্তান-সন্ততিদের সাথে হাসি-কৌতুক করলে তো সমসময় আল্লাহর স্মরণে মগ্ন থাকা যায় না। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তাঁকে হাসি-ঠাট্টার ব্যাপারে বারণ না-করে বলেছিলেন, ‘কিন্তু হানযালা, কখনো কখনো এমন হাসি-মজা করতে হয়।’
হাসি-মজা, আনন্দ-বিনোদন জীবনের জন্য দরকারি বিষয়। বিনোদনের সারবত্তা খাবারে লবণের মতো জরুরি। পরিমিত ব্যবহার খাবারকে সুস্বাদু করে তোলে, আবার অতিরিক্ত ব্যবহার খাবারকে বিষ বানিয়ে ফেলে; বিনোদনের অপরিহার্যতা ও বর্জনীয়তা লবণের মতোই। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেজন্যই জীবনকে কৌতুকময় হাস্যকর উপাদানে পরিণত করেননি, আবার কৌতুকহীন বিমর্ষতায় জীবনকে শুষ্ক ও শূন্যতায় ভরিয়েও তোলেননি; এক নিপুণ পরিমিতি তাঁর সংসারজীবনকে সুখময় স্বর্গ করে তুলেছিল। আয়েশা রা. বলেন, ‘একবার আমরা দৌড়ের পাল্লা দিলাম। আমি ছিলাম হালকা-পাতলা। দৌড়ে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগে চলে গেলাম। এরপর আরেকদিন আমরা দৌড়-প্রতিযোগিতা করলাম। এই পাল্লায় নবীজি আমার আগে চলে গেলেন। এবার আমি একটু ভারী হয়ে উঠেছিলাম। দৌড়ে জিতে গিয়ে নবীজি বললেন, এটা আগের হারের শোধ। কী সহজ, সাধারণ আর মজার ছিলো রাসূলের জীবন। কী নির্মল সুন্দর করে তিনি আনন্দ করতে পারতেন।’
আয়েশা রা. আরেকটি ঘটনার বিবরণ করেছেন। একদিন ঈদের দিন। বাইরে দুই হাবশি ঢাল ও বর্শা দিয়ে খেলছিলো। আয়েশা রা. যে বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে বোঝা যায়, নবীজি নিজে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছেন, তিনি খেলা দেখতে চান কি না, অথবা এমনও হতে পারে, তিনিই খেলা দেখার শখের কথা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বললেন। আয়েশা রা.-এর আগ্রহ বা নবীজির আগ্রহে আয়েশা রা. যখন খেলা দেখতে চাইলেন, তখন তিনি আয়েশা রা.-কে তাঁর পেছনে দাঁড় করালেন। আয়েশা রা.-এর গাল তাঁর গালের সাথে মিশে ছিলো। একসময় খেলা দেখতে-দেখতে আয়েশা রা. বিরক্ত হয়ে পড়লে রাসূলুল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি আর দেখতে চাও না?’ আয়েশা রা. বললেন, ‘না।’ তখন নবীজি বললেন, ‘তাহলে এখন যাও।’
নবীজি এক সফরে ছিলেন। সফরে পুরুষদের কাফেলা তদারকি করছিলেন এক সাহাবী, আর মহিলাদের কাফেলা তদারকি করছিলেন আরেক সাহাবী—নবীজির গোলাম সুন্দর কণ্ঠের অধিকারী হযরত আনজাশা রা.। আনজাশা রা. নারীদের নিয়ে দ্রুত উট হাঁকাচ্ছিলেন। দেখে নবীজি বললেন, ‘তোমার কী হলো, আনজাশা? কাঁচ নিয়ে ধীরে চলো।’ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদের গঠন-প্রকৃতির সঙ্গে কাঁচের তুলনা দিয়েছেন। তিনি এখানে সত্যও বলেছেন, আবার কৌতুকও করেছেন।
আয়েশা রা. বলেন, ‘একবার রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে এসে দেখতে পেলেন, আমার সামনে দুই শিশু বুয়াস যুদ্ধের গান গাইছে। তিনি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়লেন। এমন সময় আবু বকর রা. ঘরে এলেন। আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, রাসূলের সামনে এইসব শয়তানের বাদ্য বাজানো হচ্ছে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দিকে তাকালেন এবং বললেন, তাদের ছেড়ে দাও। তিনি অন্যমনস্ক হলে আমি শিশু দুটিকে ইশারায় চলে যেতে বললাম।’
এভাবেই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে হাসি-কৌতুক করে এবং স্ত্রীদের হাসি-কৌতুক-আহ্লাদে সায় দিয়ে তাঁদের জীবন ও সংসারকে আনন্দে উদ্বেলিত করে তুলেছিলেন।
ঘটনাসূত্র : বুখারী, আবু দাউদ, মুসলিম