ঘুমের সময় জীবনটা কেমন যেন থেমে থাকে। ঘুম থেকে উঠেই জীবনের গতি শুরু হয়। এই শুরুটা যেন ঠিকঠাক হয়, সে জন্য ঘুম থেকে উঠার পরেও কিছু আয়োজন ও অনুষঙ্গ থাকে। এক্ষেত্রে নবীজির কিছু নির্দেশনা ও আদর্শ আছে।
১) দ্রুত ঘুম থেকে উঠতে হবে
নবীজি খুব দ্রুত ঘুম থেকে উঠতেন। এবং ঘুম উঠে চোখে-মুখে হাত বুলিয়ে নিতেন, ঘুম দূর করার জন্য। হাদিসে এসেছে, নবীজি মোরগের ডাক শুনলেই উঠে যেতেন।[1. ( বুখারি ১১২১ )] ইবনে আব্বাস রাদিঃ বলেন, আমি আমার খালা মাইমুনার বাড়িতে রাত কাটালাম, দেখলাম নবীজি উঠে ঘুম দূর করার জন্য চেহারায় হাত বুলিয়ে নিচ্ছেন।[2. ( বুখারি ৪৫৭ )]। বস্তুত দেরী করে ঘুম থেকে উঠলে সময়ে বরকত হয়না, অলসতা ও ক্লান্তি সৃষ্টি হয়। নামাজ ছুটে যাবার আশংকা তৈরি হয়।
২) ঘুম থেকে ওঠে দোয়া-দুরুদ
নবীজি ঘুম থেকে উঠে আল্লাহর প্রশংসায় একটা দোয়া পড়তেন। হুজাইফা রাদিঃ বলেন, নবীজি ঘুম থেকে উঠে এই দোয়া পড়তেন, আল হামদু লিল্লাহিল্লাজি আহইয়ানা বা’দা মা আমাতানা ওয়া ইলাইহিন নুশুর। [3.( বুখারি ৬৩১২)] আল হামদু লিল্লাহিল্লাজি রাদ্দা আলাইয়া রুহী ওয়া আফানী ফী জাসাদী ওয়া আজিনা লী বিজিকরিহী [4.( আজকার ২৭)]। বস্তুত ঘুম কিছুটা সাময়িক মৃত্যুর মতোই। এই সাময়িক মৃত্যুর পর আবারো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পেরে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। বস্তুত তিনিই তো আমাদেরকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার তওফীক দেন। শারীরিক সুস্থতা দান করেন। আসলে ঘুম তো মানুষের সামনে জীবন, মৃত্যু ও সুস্থতার বাস্তবতা প্রকাশ করে, এর থেকে শিক্ষা গ্রহণের প্রেরণা যোগায়।
৩) তিলাওয়াত
ঘুম থেকে ওঠে সূরা আলে ইমরানের শেষ রুকু তেলাওয়াত করাও নবীজির অভ্যাস ছিল। সূরা আলে ইমরানের শেষ বারো আয়াত, একশো একানব্বই আয়াত থেকে নিরানব্বই আয়াত পর্যন্ত। এই আয়াতগুলোতে আছে, আল্লাহর সৃষ্টি মহত্ত্ব, দোয়া, ঈমান-কুফুর ও আমল বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনা। বান্দার তো দিনের শুরুতেই এই বিষয়গুলোর সাথে পরিচিত হওয়া উচিত। এর আলফাজ, মাকাসেদ ও তারান্নুমের সাথে পরিচিত হওয়া উচিত। কোরআন তিলাওয়াত দিয়ে দিন শুরু হওয়া উচিত।
৪) পরিচ্ছন্নতা
ঘুম থেকে ওঠে নবীজি মেসওয়াক করতেন, উভয় হাত কব্জি পর্যন্ত ধৌত করতেন তারপর ওজু করতেন এবং বিশেষভাবে তিনবার নাক পরিষ্কার করতেন। কেননা ইবনে উমর রাদিঃ বলেন, নবীজি ঘুম থেকে ওঠে প্রথমেই মেসওয়াক করতেন। [5.( মুসনাদে আহমদ ৫৯৭৯ )]। নবীজি বলেছেন, ঘুম থেকে ওঠে তিনবার হাত না ধুয়ে পানির পাত্রে হাত দিয়ে দিও না।[6. ( মুসলিম ১৬২ )] নবীজি বলেছেন, তোমাদের কেউ ঘুম থেকে উঠলে ওজু করো এবং নাক তিনবার পরিষ্কার করো। [7.( বুখারি ৩২৯৫)]। ইসলাম পরিচ্ছন্নতা ও পরিশীলতার ধর্ম। ঘুম থেকে ওঠে প্রথমেই মেসওয়াক করার মাধ্যমে রাতে মুখ পরিচ্ছন্ন করে নিবে। কেননা মুখে খাদ্যকণা ইত্যাদি জমে থাকে। লালা জমে থাকে। এতে দুর্গন্ধ ও জীবাণু সৃষ্টি হয়। মিসওয়াকের মাধ্যমে শুরুতেই তাই মুখ পরিষ্কার করতে বলা হয়। তারপর হাত ধুতে হবে। কেননা ঘুমে থাকাকালীন সময়ে কোথায় কোথায় হাত গিয়েছে, কি কি লেগেছে, সে তো তা জানেনা। তাই পানিতে হাত দেওয়ার আগেই ধুয়ে নিবে। এই প্রস্তুতি শেষ ওজু করবে। এবং নাকে বিশেষভাবে তিনবার পানি দিবে। কেননা ঘুমের সময় নাক খুলা ছিল। নাকে নানা কিছু এসেছে। হাদিসের ভাষায়, নাকে শয়তান ও তার ওয়াসওসাও এসেছে।
৫) পরিবারকে জাগানো ও নামাজ
পরিচ্ছন্ন হওয়া তো শেষ। এখন ঘরের বাকী মানুষদের জাগাতে হবে এবং জাগিয়ে মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য যেতে হবে। কেননা নবীজি বলেছেন, যে ব্যক্তি রাতের ঘুম থেকে নিজে ওঠে, স্ত্রীকেও ওঠায় এবং দুই রাকাত নামাজ আদায় করে, তো সে ও তার স্ত্রী অধিক জিকিরকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।[8. ( আবু দাউদ ১৪৫১)]। একইভাবে নবীজি বলেছেন, ঘুমে থাকাকালীন সময়ে শয়তান মানুষের গর্দানে তিনটি গিঁট মারে। এবং প্রত্যেকটি গিঁট বলতে থাকে, রাত এখনো অনেক বাকী, আরও কিছু সময় ঘুমিয়ে থাকো। ঘুম থেকে ওঠে আল্লাহর জিকির করলে, প্রথম গিঁট খুলে যায়, ওজু করলে আরও একটি গিঁট খুলে যায় এবং নামাজ পড়তে তৃতীয় গিঁটও খুলে যায়। মানুষ কর্মোদ্যমী হয়ে যায়, তার মনও উৎফুল্ল হয়ে যায়। অন্যথায় মানুষ কর্মোদ্যমহীন হয়ে যায়, মনেও উৎফুল্লতা থাকেনা। [9.( বুখারি ১১৪২ )]। ইসলাম নিছক ব্যক্তিগত ধর্ম নয়, তাই, গৃহকর্তার যেমন নিজে ঘুম থেকে উঠতে হবে, তেমনি পরিবারের সদস্যদের ঘুম থেকে ওঠানোর দায়িত্বও নিতে হবে। এবং সর্বশেষ নামাজ পড়ে ঘুম থেকে ওঠার আয়োজন শেষ করতে হবে।
ঘুম থেকে যেনতেন ভাবে উঠলে চলবেনা। ঘুম থেকে ওঠার পর আগুয়ান দিনের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে নানা রকম আয়োজনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। কেমন হবে সেই আয়োজন, নবীজির নির্দেশনা ও আদর্শের মধ্যে রয়েছে এর অনেক শিক্ষা।