দাস-দাসীর ব্যাপারে নবীজির আদর্শ

সে সময়ের আরব, যখন ছিলো নবীজির সময়, তখন সেখানে ছিলো দাসপ্রথা। প্রায় পুরো পৃথিবী জুড়েই ছিলো এই প্রথার উপস্থিতি। দাস মানে হলো একজন মানুষের কাছে অর্থের বিনিময়ে অধীনস্থ হয়ে থাকা। এই অধীনস্থতা শুধু যদি কাজ-কর্ম বা খাটাখাটনির অধীনস্থতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো, তাহলে এতে অন্যায় কিছু ছিলো না; কিন্তু এই অধীনস্থতা এর সীমা ছাড়িয়ে অনেক অন্যায়ের দিকে আবদ্ধ হয়ে পড়ছিলো। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাসদের এই দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তিনি দাসদের জন্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন অধিকার। শরীয়তে দাসদের সাথে ব্যবহারের বিধি নির্ধারণ করেছিলেন। তাদের উপর অন্যায় হলে একমাত্র কাফফারা রেখেছিলেন তাদের মুক্তি বা আজাদ করে দেওয়াকে।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরও দাস ছিলো। কিন্তু তাঁরা নিজেদের দাস মনে করতে পারতেন না। রাসূলের কোনো আচরণ তাঁদেরকে দাস ভাবতে সুযোগ দিতো না। তাঁরা ছিলেন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্তানের মতো। তাঁদের সকল অভাব-অভিযোগ, দরকার, প্রয়োজন তিনি নিজে তদারকি করে ঠিক করে দিতেন। তাঁদের সংসারের ব্যবস্থা করতেন। তাঁদের সুখ-দুঃখকে নিজের সুখ-দুঃখ ভাবতেন এবং তা উদযাপন করতে ও লাঘব করতে গিয়ে তাঁকে একজন পিতার মতো সুখী ও সক্রিয় দেখা যেতো। দাসদের প্রতি পাশবিক আচরণের যে মর্মান্তিক ধারা জাহেলি যুগে খুব স্বাভাবিক ছিলো, তার পথ তিনি চিরতরে বন্ধ করে দেন। কুরআনে দাসমুক্তির জন্য জারি হয় খুব সহজ ও সোজা ফরমান। মালিক নামের পশুদের চালিয়াত থেকে মুক্ত হয় খাঁচায় আটক পাখির মতো দাস-জীবন। বরং এমন নজির স্থাপন করেন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাসেরা তাঁর অধীনস্থতা থেকে মুক্ত হতে চাইতো না; আজাদ করে দিলেও তাঁরা থেকে যেতেন রাসূলের মমতার অবারিত ধারায়…

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাসদের অধিকারের ব্যাপারে বলেন, ‘তোমাদের দাস তোমাদের ভাই। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। তাই, যার ভাই তার অধীনে আছে, সে যেন তাকে সেই আহার দেয়, যা সে নিজে আহার করে; নিজে যে কাপড় পরিধান করে, তাকেও সে কাপড় পরিধান করায়। সাধ্যের বাইরে তাদের উপর কোনো ভার চাপিয়ে দেবে না। যদি চাপিয়ে দাও, তাহলে তাদের সহযোগিতা কোরো।’

এভাবেই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাসত্বের নীচতা থেকে তাদেরকে ভ্রাতৃত্বের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে উন্নীত করেছেন। আপন ভাইয়ের প্রতি অপর ভাইয়ের যেই দায়িত্ববোধ, মমতাবোধ ও সহযোগিতাবোধ, সেই একই বোধের জায়গা থেকে দাসদের অধিকার তিনি নিশ্চিত করেছেন।

একবার আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. তাঁর দাসকে মারলেন। তারপর দাসকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি?’ দাস বললো, ‘না।’ ইবনে ওমর রা. বললেন, ‘আজ থেকে তুমি স্বাধীন।’ এরপর ইবনে ওমর রা. কিছু মাটি হাতে নিলেন। বললেন, ‘এই যে দাসকে মুক্ত করলাম আমি, এই মুক্তির জন্য আমি এই মাটি বরাবর সওয়াবও পাবো না। আমি তো রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি তার দাসকে অপরাধের চেয়ে বেশি প্রহার করলো, তার প্রহারের কাফফারা তাকে মুক্ত করে দেওয়া।’

সুওয়াইদ ইবনে মুকাররিন রা. বলেন, ‘আমি একবার রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ছিলাম। আমি ভাইদের মধ্যে সপ্তম। আমাদের একটি দাস ছিলো। আমাদের একজন তাকে আঘাত করলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাসকে আজাদ করে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন।’

দাস-দাসীদের ব্যাপারে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিকার ও মর্যাদার সীমা এতটাই নির্ধারণ করে দিয়েছেন যে, তিনি দাসদেরকে ‘আমার গোলাম’ বা ‘আমার বাদি’ বলে ডাকতে নিষেধ করেছেন মনিবদেরকে; বরং তাদেরকে ‘আমার ছেলে’ বা ‘আমার মেয়ে’ বলে ডাকতে নির্দেশ দিয়েছেন।

এ ছাড়া আগেই বলা হয়েছে, ইসলামে দাসচুক্তি এমন কোনো ব্যাপার নয় যে, জনম ভর এই দাসত্বের বোঝা বইতে হবে; বরং ইসলামে দাসপ্রথা একটি সাময়িক চুক্তিমাত্র। কুরআনে এ ব্যাপারে আয়াত এসেছে—‘তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীর মধ্যে যারা অর্থের বিনিময়ে মুক্তিলাভের চুক্তি করতে চায়, তোমরা তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হও, যদি তাদের মধ্যে কোনো কল্যাণ দেখতে পাও।’

ইসলামী আইনশাস্ত্রে জ্ঞানী ইবনে হাজম রহ. বলেছেন, ‘আয়াতের আদেশসূচক আয়াতের মাধ্যমে বোঝা যায়, দাস-দাসী মুক্তিচুক্তিতে আবদ্ধ হতে চাইলে মনিবের জন্য তা করা অপরিহার্য। এই হলো রাসূল-প্রণীত শরীয়তে জাহেলি যুগের জঘন্য দাসপ্রথার ব্যাপারে নবীজির আদর্শ।

ঘটনাসূত্র : বুখারী, মুসলিম