রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয়তম বিষয়গুলোর একটি ছিলো নারী। আজকে যখন নারীর খুব বাজারদাম উঠেছে, যখন ইসলামের শত্রুরা প্রচার করছে, নবীজি ছিলেন এক নারীলোলুপ অসভ্যজন, তখন খুব সহজেই ইসলামের শত্রুদের প্রোপাগান্ডা আমাদের কাছে সত্য বলে ভ্রম হবে; রাসূলুল্লাহর ব্যাপারে তাদের ছড়ানো মিথ্যায় আমরা তাঁকে গভীরভাবে না-পড়ে, না-বুঝেই ভেসে যাবো; বা আমরা রাসূলের অন্যান্য বিষয়-আশয়কে নিয়ে গর্ব করলেও এ বিষয়ে থেকে যাবো নীরব। কিন্তু অনেক সময়ই বুঝবো না, রাসূলের ব্যাপারে আমাদের এই নীরবতাও শত্রুদের একরকমের মনস্তাত্ত্বিক বিজয়। অথচ আমরা যদি রাসূলের জীবনের দিকে গভীর অন্বেষা নিয়ে তাকাতাম, তাহলে দেখতে পেতাম, যেই প্রচার দিয়ে তাঁকে অপাঙক্তেয় করে তোলা হয়েছে, আমরা ফেঁসে গেছি যেই মিথ্যে প্রোপাগান্ডায়, সেই মিথ্যার আবরণের নিচেই কত দীপ্রভাবে জ্বলছে সত্যের গৌরব।
প্রিয়তম রাসূল যখন বলছেন, তাঁর প্রিয় একটি বিষয় নারী, তখন আমাদের তাকাতে হবে অতীতের দিকে—কখন তিনি এই কথা বললেন? বললেন এমনই এক সময়ে, যখন নারী গন্ধময় ভাগাড়ের উৎকট আবর্জনা; বললেন এমনই এক সময়ে, যখন নারী এতই কলঙ্কের যে, সদ্যভূমিষ্ট সন্তানেও ভাগ করা হচ্ছে নর নাকি নারী,—শিশু বলে তার স্তর নির্ধারণ হচ্ছে না, হচ্ছে নারী হিশেবে; বললেন এমনই এক সময়ে, যখন শূন্যে ছুড়ে-দেওয়া কন্যাশিশুর পতনের কাছে পিতাই ধরে আছেন তলোয়ার, এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছে কোনো শিশু নয়, নারী; বললেন এমনই এক সময়ে, যখন নারী খুবই দুর্মূল্য—বাজারে বিকোয় না, প্রেমিকের প্রেম পায় না, পিতার স্নেহ পায় না, স্বামীর ভোগের মাংস হয়, ভালোবাসা পায় না; বললেন এমনই এক সময়ে, যখন এক নারীকে একই সময়ে ভোগ্যা বানাচ্ছে অনেক-অনেক পুরুষ; বললেন নারীর এমনই করুণ-বিষণ্ন লম্বমান জাহেলিয়াতের পাটাতনের উপর দাঁড়িয়ে ।
পরিবর্তিত আজকের সমাজের দিকে তাকিয়ে বোঝা যাবে না, সেদিনকার অবস্থা; আজকের এই পরিবর্তনের দিনেও, যখন নারীর উত্তরণ হয়নি সেদিনকার ওই জাহেলিয়াত থেকে, বরং জাহেলিয়াতকেই সে করে তুলেছে মুকুট, নারী হয়ে উঠেছে দুর্লভ সোনার হরিণে, সবার চোখেই যখন নারীর অপার কামিতা, এই এমন সময়ে এসে বোঝা যাবে না রাসূলের ওই প্রিয়তম কথাটি। ওই কথাটির মানে বুঝতে আরবের নৃশংসতা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল থাকতে হবে, তারপর দাঁড় করাতে হবে এই পৃথিবীর বুকে-আসা সকল আদর্শপ্রণেতাদের, তারপর তাদের সাথে রাসূলের এক নির্মোহ বিশ্লেষণের তুলনায় তৎপর হলে বোঝা যাবে, আজকে যতটুকু নারীর মর্যাদা, তার উত্তরাধিকার কোথাকার ফসল; এবং বোঝা যাবে এও, নারী-উন্নয়নের নামে নারীবাদিতার কোথায়-কোথায় রয়েছে নারীকে আজও পণ্য করে তোলার জিগির।
রাসূল নারীকে ভালোবাসতেন তার সব রূপেই। নারী মানে এখানে নারীই। তার সকল রূপ মিলেই তার সত্তা। রাসূল ভালোবাসতেন নারীর এই কল্যাণকর সত্তাকে। তিনি ভালোবাসতেন তাঁর মাকে, তাঁর দুধমা হালিমাকে, তাঁর খালা ও ফুফুদেরকে, তাঁর স্ত্রী ও কন্যাদেরকে। এতই ভালোবাসতেন তিনি নারীদের, বলেছিলেন, বলেছিলেন জাহেলিয়াতের প্রতি ভর্ৎসনা জাগিয়ে, ‘তোমাদের কন্যাশিশু তোমাদের প্রতি রহমত।’ জাহেলিয়াতে মোড়া চিরনষ্ট পিতৃতন্ত্রে আঘাত করে বলেছিলেন, কন্যাশিশুর প্রতি পিতাদের অধিক সজাগ থাকতে। পুরো পুরুষ-সমাজকে নিয়ে গিয়েছিলেন মাতৃত্বের বিগত সেই ব্যথাকাতর জঠরের সামনে,—বলেছিলেন, ‘তোমাদের মায়ের পায়ের নিচে তোমাদের বেহেশত।’ এর সবকিছুই ছিলো ওই নষ্ট সমাজে নারীর পীড়িত জীবনের পাশে রাসূলে-রহমতের প্রিয়তার সংস্কার।
তখন বদর যুদ্ধের ডগমা। ইসলামের প্রথম জিহাদ। সবাই রণপ্রস্তুতিতে ব্যস্ত। এই জিহাদ এক মুসলিমের জীবনে অপার সৌভাগ্যের ভাগ-আনা জিহাদ। ছোট-ছোট বাচ্চারাও পিছিয়ে নেই। এমনই সময়ে নবীজি উসমানকে নির্দেশ দিলেন, তাঁকে যুদ্ধে যেতে হবে না। সে নিজ স্ত্রী রুকাইয়ার সেবা করবে, এটাই তাঁর কাজ। জিহাদে না-গিয়েও সে পাবে, জিহাদের ভাগ। সত্য-মিথ্যার ভাগ্যনির্ধারণকারী এক জিহাদে উসমানের মতো জলিলুল কদর সাহাবীর জন্য স্ত্রী-সেবাকেই তিনি এগিয়ে রাখলেন এবং সেটাকেই তাঁর কর্তব্য নির্ধারণ করলেন;—এই হলেন স্রোতের বিপুল ভ্রুকুটিকে তুচ্ছ করে নারীকে প্রিয় বলা সেই অপার্থিব আকাশ-উচ্চতার মানুষটি; সময়ের তুমুল করতালিতে বসে নারীর জয়গান গাওয়া আর যখন জীবনের উপর ধসে পড়ছে অত্যাচারের পাহাড়, জীবনের উপর নেমে আসছে প্রলয়ঙ্কারী ধ্বংস, তখন নারীকে প্রিয় বলা ও একটা জীবন ভরে তা করে দেখানো ব্যাক্তিক, রাষ্ট্রিক, সামাজিক ও আদর্শিক পরিমণ্ডলে—দুইয়ের মধ্যে আকাশ আর মাটির নয়, ইহ ও পর-জীবনের পার্থক্য।
ঘটনাসূত্র :সহীহ বুখারী।