নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন ইনসাফের এক উজ্জ্বল প্রতীক। তাঁর মতো সাম্য ও সমতার দৃষ্টান্ত-স্থাপনকারী নেতা জগতে নেই। সুবিচারের এক নিপুণ নিক্তি নিয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছেন ন্যায়পরায়ণতার আলো। ন্যায়ের জন্য তাঁর সকল ধরনের পদক্ষেপ ছিলো যুগান্তকারী ও অবাক-করা। ন্যায়ের পথে স্থির থাকতে অনেক বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি তাঁকে হতে হতো, কিন্তু সেসব তাঁকে ন্যায় থেকে কখনো বিচ্যুত করতে পারেনি। তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণতার এক বলিষ্ঠ প্রবাদ।
মক্কা বিজয়ের সময় রাসূলের উপস্থিতিতে একটি ঘটনা ঘটে। বনি মাখযুম গোত্রের এক নারী চুরিতে জড়িয়ে পড়ে। কুরাইশরা এতে চিন্তিত হয়। তারা এমন পথ খুঁজতে থাকে, যা অবলম্বন করে এই নারী তার কৃত অপরাধের সাজা থেকে মুক্তি পেয়ে যায়; কেননা, মাখযুম ছিলো এক সম্ভ্রান্ত বংশ। এই অপরাধের শাস্তি হলে তাদের বংশের মুখে চুনকালি পড়বে, এই ভয়ে তারা ভিন্ন কোনো উপায় খুঁজছিলো। সে-কল্পে তারা বলাবলি করতে থাকে, কে এই ব্যাপারে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সুপারিশ করতে পারে? কার কথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেনে নেবেন? হযরত উসামা ইবনে যায়েদের কথা মনে এলো তাদের। তারা বললো, এ ব্যাপারে নবীজির প্রিয়ভাজন উসামা ইবনে যায়েদ ছাড়া আর কেউ সাহস করবেন না। তারা গিয়ে নিজেদের ভয়, আশঙ্কা ও প্রস্তাবের কথা উসামা রা.-কে বললো। তাদের অনুরোধে উসামা রা. রাসূলের সাথে কথা বলতে গেলেন। যখনই প্রসঙ্গটি তিনি তুললেন, রাগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেলো। তিনি বললেন, ‘উসামা, আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তির ব্যাপারে তুমি আমার কাছে সুপারিশ করছো?’ উসামা রা. নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহর কাছে আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।’ এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে একটি ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তীরা এভাবেই ধ্বংস হয়েছে। তাদের ধনী ও সম্ভ্রান্ত লোকেরা চুরি করলে তারা ছেড়ে দিতো, শাস্তি প্রয়োগ করতো না; আর গরিব লোকেরা চুরি করলে তার শাস্তি প্রয়োগ করতো। আল্লাহর শপথ, মুহাম্মদের কন্যা ফাতেমাও যদি চুরি করে, তবে অবশ্যই আমি তাঁর হাত কেটে দেবো। এরপর ওই নারীর হাত কাটার দণ্ড কার্যকর করা হলো। তার উত্তম তওবা নসিব হয়েছিলো।
শুধু যে অপরের বেলায়, তা-ই নয়, নিজের বেলাতেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাস্তি মেনে নিতেন। আসলে যে ব্যাপারগুলোতে তিনি নিজেকে মুখোমুখি করে দিতেন, অল্প ঘাঁটলেই দেখা যেতো, ব্যাপার আসলে কিছুই না; কিন্তু ন্যায়ের প্রতি তাঁর অবিচলতা এতই ছিলো যে, তাঁর হাজারটি কথা বলার সুযোগের মধ্য থেকে একটি সুযোগ অপরের পক্ষে থাকলে তিনি ওই ব্যাপারে নিজের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা ঠুকে দিতে পারতেন। একবার এক ইহুদি, যিনি পরে মুসলিম হয়েছিলেন, রাসূলের ধৈর্যের পরীক্ষা নেওয়ার জন্যই নিজের পাওনা টাকার তাগাদাকে ছুতো করে রাসূলের কাপড় টেনে ধরে চূড়ান্ত অপমান করেন। সামনে ছিলেন রাসূলের প্রিয় সাহাবী হযরত ওমর রা.। তিনি রেগে গিয়ে তাঁকে কিছু বলতে চাইলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘ওমর, এর ভিন্ন আচরণই কি তার প্রাপ্য ছিলো না? তুমি আমাকে ঋণ পরিশোধের কথা বলতে আর পাওনাদারকে সুন্দর করে চাওয়ার উপদেশ। আর সে তো আসলেই পাওনাদার। তার তো অধিকার আছে।’ কিন্তু মূল ঘটনা হলো, পাওনা পরিশোধের আগেই ওই ইহুদি পাওনা চেয়ে রাসূলকে চূড়ান্ত অপমান করে। তথাপি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এইভাবে নিজেকে দায়ী করে নেওয়া এবং এই আচরণের জন্য ইহুদিকে কিছুই না-বলা তাঁর ন্যায়পরায়ণতারই এক উৎকর্ষতম প্রকাশ।
এভাবেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নানাভাবে নানা পর্যায়ে তাঁর ন্যায়পরায়ণতার নীতিকে বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। তার দৃষ্টান্ত অনেক এবং তার বৈচিত্রও বিপুল। একটি-দুটি ঘটনায় তার পূর্ণাঙ্গ পরিচয় বা চিত্র ফোটে না। তবে অরাজকতার এই সময়ে তাঁর ন্যায়পরায়ণতা আমাদেরকে নতুন এক পথ ভাবার পথে চালিত করতে পারবে।
ঘটনা ও সূত্র : বুখারী, মুসতাদরাক