নবীজির ন্যায়পরায়ণতা-২

ন্যায়পরায়ণতার ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বহুমুখি বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু অবস্থা বা পরিস্থিতি যা-ই হোক, তিনি কখনোই ন্যায়পরায়ণতা থেকে বিচ্যুত হননি। এই গুণটির ব্যাপারে তাঁর নিষ্পাপ আগ্রহের কথা সাহাবীরা জানতেন বলে দুই সাহাবী মজার দুটি ঘটনাও ঘটিয়েছিলেন।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু লোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। সেখানে হাসাহাসিও হলো। তিনিও তাঁদের হাসালেন। লাঠি দিয়ে একজনের কোমরে খোঁচা মারলেন। লোকটি বলে উঠলো, ‘আমাকে বদলা নিতে দিন।’ এটা কিন্তু পরস্পরের হাসাহাসির মধ্য দিয়ে ঘটা একটা ব্যাপার ছিলো। আর রাসূলের লাঠি দিয়ে খোঁচা দেওয়াটা হাস্যরসেরই একটা অংশ ছিলো। তবু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘নাও বদলা।’ লোকটি বললো, ‘আপনার শরীরে তো জামা আছে, আমার শরীরে তো কোনো কাপড় ছিলো না।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামা ওঠালেন। তখন লোকটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জড়িয়ে ধরলো এবং তাঁর কোমরে চুমু খেলো। বললো, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি এটাই চেয়েছিলাম, অন্য কিছু নয়।’

বদর যুদ্ধে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের কাতারবন্দী করছিলেন। কাতার সোজা করতে-করতে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাওয়াদ ইবনে গাযিয়্যা রা.-এর পাশ দিয়ে গেলেন। তিনি কাতার থেকে একটু সামনে বেড়ে গিয়েছিলেন। নবীজি তিরের মাথা দিয়ে তাঁর পেটে খোঁচা মেরে বললেন, ‘সোজা হয়ে দাঁড়াও, সাওয়াদ।’ সাওয়াদ রা. বললেন, ‘আপনি আমাকে ব্যথা দিয়েছেন, হে আল্লাহর রাসূল। আল্লাহ তায়ালা আপনাকে সত্য ও ইনসাফ নিয়ে প্রেরণ করেছেন; সুতরাং আমাকে বদলা নিতে দিন।’ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পেটের কাপড় উঠালেন। বললেন, ‘বদলা নাও।’ সাওয়াদ রা. তখন রাসূলকে জড়িয়ে ধরলেন এবং পেটে চুমু খেলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন এমন করলে, সাওয়াদ?’ সাওয়াদ রা. বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমি চেয়েছি শেষ মুহূর্তে আপনার চামড়ার সাথে আমার চামড়া স্পর্শ করুক।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কল্যাণের জন্য দোয়া করলেন।

এই দুইটি ঘটনার ফলাফল যত মজার আর প্রেমপূর্ণ হোক না কেন, এই দুইটি ঘটনাতেও ন্যায়পরায়ণতার প্রতি রাসূলের অকুণ্ঠ ঝোঁকময়তা ফুটে ওঠে এবং ফুটে ওঠে পরিস্থিতি ঘটনা বা বিষয় যত সামান্যই হোক না কেন, ন্যায়পরায়ণতার ব্যাপারে রাসূলের পক্ষপাত সর্বদা এক পারদেই অবস্থান করে।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। হুনাইনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গনিমত-বণ্টনে কিছু মানুষকে প্রাধান্য দিচ্ছিলেন। আরবের কিছু সম্মানিত ব্যক্তি, যাঁরা নতুন মুসলিম হয়েছিলেন, তাঁদেরকে তিনি গনিমতের ভাগ বেশি দিচ্ছিলেন, এমন দেখা গেলো। এক ব্যক্তি বলে উঠলো, ‘আল্লাহর কসম, এই বণ্টনে ইনসাফ করা হয়নি। এতে আল্লাহর সন্তুষ্টি উদ্দেশ্য ছিলো না।’ আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. লোকটির কথা শুনে বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, এই কথা আমি রাসূলকে জানাবো।’ তারপর তিনি রাসূলকে গিয়ে বলেন। এতে রাসূল খুবই ব্যথিত হন। ইবনে মাসউদ রা. বলেন, ‘আমি যদি জানতাম, তিনি এত ব্যথিত হবেন, এ কথা আমি তাঁকে বলতাম না।’

আসলে আনসার সাহাবীদের যাঁরা অনভিজ্ঞ, তাঁদের ভেতর থেকেই এমন কথা ছড়িয়ে পড়েছিলো। মূলত আপাতচক্ষে যা দেখা যাচ্ছিলো, তার পেছনে অন্য এক রহস্য ছিলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গনিমত যার যা প্রাপ্য, তাকে তা-ই দিচ্ছিলেন; সাথে-সাথে আরবের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গকে প্রাধান্য দেওয়ার যে ব্যাপারটি দেখা যাচ্ছিলো, তা হলো, রাসূলের ভাগের অংশও তাদের দিয়ে দেওয়া; রাসূলের অংশ তো রাসূল যাকে ইচ্ছা তাকে দিতে পারেন। আর এই দেওয়ার পেছনেও ছিলো গূঢ় রহস্য ও সুন্দর উদ্দেশ্য। তা হলো, নতুন ইসলামে দীক্ষিত এসব মানুষের মন যেন ইসলামের প্রতি দৃঢ় হয়।

তবুও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবার থেকে আলাদা করে আনসার সাহাবাদের একত্র করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘প্রিয় আনসারেরা, শুনলাম, তোমাদের মনে কীসব প্রশ্নের উদয় হয়েছে? কোন ব্যাপার তোমাদেরকে তোমাদের রাসূলের ব্যাপারে সাড়া দিতে বাধা দিলো?’ আনসাররা বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, নেতৃস্থানীয়দের কাজ নয় এসব। অল্পবয়সী কয়েকজন কিছু বলে ফেলেছে। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করুন।’ রাসূল বলে উঠলেন, ‘হে আনসার-সম্প্রদায়, আল্লাহ কি আমার মাধ্যমে তোমাদের পথ দেখাননি? তোমরা কি নিজেদের মধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিলে না? তোমরা কি ছিলে না দরিদ্র? আমার মাধ্যমেই আল্লাহ তায়ালা তোমাদের সচ্ছলতা দান করেছেন। আমি যাদেরকে বেশি-বেশি উপঢৌকন দিয়েছি, তারা কিছু দিন আগেও কাফের ছিলো। তারা সেসব নিয়ে নিজ-নিজ অবস্থানে চলে যাবে। এই কি তোমাদের কাছে আনন্দের নয় যে, তোমাদের রাসূল নিজে তোমাদের মধ্যে রয়ে গেলো? তোমরা কি এতে খুশি নও, অন্যরা নিজেদের সাথে নিয়ে যাবে উট-বকরি, আর তোমাদের নিজেদের ঘরে নিয়ে ফিরবে তোমাদের রাসূলকে? আমাকে যদি না-করানো হতো, তবু আমি আনসারদের একজন হতাম; মানুষ যদি বিভিন্ন ঘাঁটি বা উপত্যকা গ্রহণ করতো, আমি আনসারদের উপত্যকা গ্রহণ করতাম।’ রাসূলের এই মর্মস্পর্শী কথায় আনসাররা কাঁদতে শুরু করলেন। তাঁরা এত কাঁদছিলেন যে, তাঁদের দাড়ি ভিজে গেলো। তাঁরা বলতে লাগলেন, ‘আমরা আমাদের রাসূলকে পেয়ে সন্তুষ্ট।’

আনসাররা নিজেদের ভুল বুঝতে পারলেন। বুঝতে পারলেন কত ন্যায়পরায়ণ একজন মানুষ তাঁদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কত বিচিত্র উপায়েই না তিনি ন্যায়ের রজ্জুতে বেঁধে রাখেন তাঁর সমগ্র সত্তা।

ঘটনা ও সূত্র : বুখারী, সীরাতে ইবনে হিশাম