নবীজির পুণ্যাত্মা স্ত্রীগণ

মনযূরুল হক

নবীজির মোট এগারোজন স্ত্রী ছিলেন। জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেছেন দু’জন— খাদিজা ও উম্মুল মাসাকিন যয়নব রা.। বাকি নয়জন স্ত্রী রেখে গেছেন— আয়েশা, হাফসা, উম্মে হাবীবা, যয়নব বিনতে জাহাশ, উম্মে সালামা, মাইমুনা, সাওদা, জুওয়াইরিয়া, সাফিয়া।

খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ : খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ ইবনে আসাদ ইবনে আব্দুল ওযযা ইবনে কুসাই রা.। তার বংশধারা নবীজির স. পঞ্চম পুরুষ কুসাই ইবনে কিলাব-এর সাথে মিলিত হয়েছে। তিনি ছিলেন কুরাইশ নারীদের মধ্যে বংশধারায় মধ্যম, মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ এবং ও সম্পদে ধনাঢ্য। [1.(সীরাতে ইবনে হিশাম, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৮৯)]

নবীজির স. সাথে বিয়ের পূর্বে তার আরও দু’বার বিয়ে হয়েছিল। প্রথমে আতিক ইবনে আবিদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে মাখযুম-এর সাথে। এই ঘরে একটি ছেলে ‘আব্দুল্লাহ’ ও একটি মেয়ে ‘হিন্দ’ জন্মগ্রহণ করে। হিন্দ মুসলমান হয়েছেন। [2.(সীরাতে ইবনে হিশাম, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৬৪৪)]  আতিক মারা যাওয়ার পরে তিনি বিবাহ করেন আবু হালা ইবনে নাবাশ ইবনে যারারা তামীমিকে। তিনিও মারা গেছেন। এই ঘরেও হিন্দ ও হালা নামে দুটি সন্তান হয়, দু’টিই ছেলে এবং উভয়েই মুসলমান হয়েছেন।

তিনি মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ স.-এর সততা ও বিশ^স্ততার কথা জানতে পেরে তাকে ব্যবসায় নিয়োগ করেন। পরে তার আগ্রহেই নবীজির স. সঙ্গে বিবাহ হয়। সে-সময় নবীজির বয়স ছিলো পচিঁশ এং খাদিজার ছিলো পঁয়ত্রিশ। [3.(আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৯৪)]  তিনি জীবিত থাকতে নবীজি কাউকে বিবাহ করেন নি। ইবরাহিম ছাড়া নবীজির সকল সন্তানের জন্ম হয় খাদিজার রা. গর্ভে থেকে।

তিনি ইন্তেকাল করেন হিজরতের তিন বছর পূর্বে, পয়ষট্টি বছর বয়সে। একই বছর আবু তালিব মারা যান। এ-বছরকে তাই ‘শোকের বছর’ বলা হয়। [4.(শরহে যুরকানী আলাল মাওয়াহিব, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ২২৩)]  ‘হাজুন’ নামক স্থানে তাকে দাফন করা হয়।

সাওদা বিনতে যাময়া : সাওদা বিনতে যাময়া ইবনে আব্দুশ শামসকে খাদিজা রা.-এর ইন্তিকালের পরে নবীজি বিবাহ করেন, মক্কায়।

এর আগে সাওদা তার চাচার ছেলে সাকবান ইবনে আমর-এর বিবাহধীন ছিলেন।¬ স্বামী-স্ত্রী উভয়েই প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং হাবশায় দ্বিতীয় হিজরত করেন। হাবশার মুহাজিরদের সাথে মক্কায় ফেরার পর সাওদার স্বামী মারা যান।

মদিনায় হিজরতের পর বার্ধক্য এসে পড়লে তার আশংকা হয়, নবীজি তাকে তালাক দিয়ে দেন কি না, যদিও নবীজির পক্ষ থেকে এমন কোনো আচরণ পান নি। তাই তার জন্যে নবীজিকে পাওয়ার নির্ধারিত দিনটি আয়েশাকে দিয়ে দেন। তিনি ইন্তেকাল করেছেন ওমর রা.-এর খেলাফতের শেষ দিকে। [5.(শরহে যুরকানী আলাল মাওয়াহিব, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ২২৯)]

আয়েশা সিদ্দিকা : আয়েশা বিনতে আবু বকর সিদ্দিক রা. জন্মগ্রহণ করেন ইসলামের আবির্ভাবের পরে। (বুখারি, হাদিস ৩৯০৫)  তার মা উম্মে রুমান প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণ করেন, মদিনায় হিজরত করেছেন এবং ষষ্ঠ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। নবুয়তের দশম বছরে নবীজির স. সাথে বিবাহ হয়। তিনি তখন ছয় বছর বয়সী। নয় বছর বয়সে মদিনায় আগমনের সাত মাস পরে প্রথম হিজরির শাওয়ালমাসে বাসর হয়। [6.(বুখারি, হাদিস ৫১৩৩)]

আয়েশা রা. হলেন নবীজির স. বিবাহিত একমাত্র কুমারী নারী। অল্প বয়স হওয়ায় নবীজিকে তাকে খেলার সাথিদের আমার সাথে খেলার স্বাধীনতা দিতেন। [7.(বুখারি, হাদিস ৬১৩০)]  তিনি ছিলেন নবীজির সবচে’ প্রিয় মানুষ। [8.(বুখারি, হাদিস ৩৬৬২)]  তিনি ছাড়া অন্য কারও সাথে একবিছানায় থাকাকালে নবীজির স. ওপর অহী নাযিল হয় নি। [9.(বুখারি, হাদিস ৩৭৭৫)]

তিনি ছিলেন উম্মতের মধ্যে সবচে’ বড় ফকীহ নারী এবং নারী-সাধারণের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী। বড় বড় সাহাবী তার বক্তব্যের দিকে ‘রুজু’ হতেন এবং তার ফতোয়া গ্রহণ করতেন। [10.(যাদুল মাআদ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১০৬)]  সাওদা রা.-কে বাদ দিলে তিনিই সবচে’ বেশি নবীজির নৈকট্য লাভ করেছেন। তার বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা দুই হাজার দুইশ’ দশটি। [11.(আস-সীরাতুন নাবাবিয়্যাতুস সাহীহিয়্যা, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৬৪৯)]  তিনি ইন্তিকাল করেন ৫৮ হিজরির রমজান মাসে। আবু হোরায়রা রা. তার জানাযার পড়ান।

হাফসা বিনতে ওমর : হাফসা বিনতে ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. জন্মগ্রহণ করেন নবুয়তের পাঁচ বছর পূর্বে। তার মা হলেন যয়নব বিনতে মাযঊন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং হিজরত করেন তার স্বামী খুনাঈস ইবনে হুযাফা সাহমি রা.-এর সাথে; যিনি বদরে অংশ নিয়ে আহত হয়েছেন এবং সেই জখমে শহিদ হয়েছেন। তৃতীয় হিজরিতে নবীজি তাকে বিবাহ করেন। তার থেকে ৬০টি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তার ইন্তেকাল হয় মদিনায় ৪৫ হিজরিতে।

উম্মুল মাসাকিন যাইনাব : তার নাম যয়নব বিনতে খুযায়মা ইবনে হারেস হিলালিয়া। মিসকিনদের খওয়ানোর কারণে তাকে জাহেলি যুগে ‘উম্মুল মাসাকিন’ (মিসকিনদের জননী) ডাকা হতো। তার পূর্বের স্বামী ছিল নবীজির ফুপাতো ভাই আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশ; যিনি উহুদ যুদ্ধে শহিদ হন। ইদ্দত শেষ হওয়ার পরে নবীজি তাকে বিবাহ করেন। কিন্তু দুই-তিন মাসের মধ্যে তার ইন্তেকাল হয়ে যায়।

উম্মে সালামা : তিনি হলেন হিন্দ বিনতে আবু উমাইয়া ইবনে মুগিরা মাখযুমি। পূর্বে তার বিয়ে হয় নবীজির স. ফুপাতো ভাই আবু সালামা ইবনে আবদুল আসাদের সাথে। স্বামীর সাথে প্রথমবারে হাবশায় হিজরত করলে সেখানে একটি মেয়ে ‘যাইনাব’-এর জন্ম হয়। এরপর সালামা, ওমর ও দুররা নামে আরও তিন সন্তানের জননী হন তিনি। স্বামীর সাথে মদিনায়ও হিজরত করেন তিনি। আবু সালামা রা. বদর ও উহুদে শরিক হন। পরে একটি অভিযানে উহুদে পাওয়া আঘাত তাজা হয়ে গেলে চতুর্থ হিজরির জুমাদাল উখরা মাসে ইন্তেকাল করেন। [12.(শরহে যুরকানী আলাল মাওয়াহিব, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ২৩৯)]

ইদ্দত শেষ হলে নবীজি তাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন।  তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুন্দরী নারী এবং একজন ফকীহও বটে। [13.(নাসায়ি, হাদিস ৩২৫৪)]  তার বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা তিনশত আটাত্তর। উম্মাহাতুল মুমিনীনের মধ্যে তিনি সবার শেষে ইন্তেকাল করেন, কারো মতে তেষট্টি হিজরি। সে-সময় তার বয়স হয়েছিলো ৮৪ বছর। [14.(শরহে যুরকানী আলাল মাওয়াহিব, খ- ৩, পৃষ্ঠা ২৪১)]

যাইনাব বিনতে জাহাশ : তার নাম যাইনাব বিনতে জাহাশ ইবনে রুআব আসাদিয়া। তার মা হলেন উমাইমা বিনতে আব্দুল মুত্তালিব। নবীজির আদেশে তিনি আজাদদাস যায়েদ ইবনে হারেসার রা. স্ত্রী হন। কিন্তু বংশ-গৌরবের কারণে তিনি নিজেকে যায়েদের চেয়ে উর্ধ্বের মনে করতেন। যায়েদ রা. অবশেষে তালাক দিয়ে দেন। ইদ্দত শেষ হওয়ার পর নবীজি তার উদ্দেশে বিবাহের পায়গাম পাঠান। আয়াত নাযিল হয়— এরপর যখন যায়েদ আপন স্ত্রী থেকে প্রয়োজন পূরণ করে নিলো, তখন আমি তাকে আপনার বিবাহে দিয়ে দিলাম, যাতে মুসলমানদের জন্য নিজেদের পালক-পুত্রের স্ত্রীদের বিয়ে করতে কোনো সমস্যা না থাকে। [15.(সূরা আহযাব, আয়াত, ৩৭)]  এর ফলে পঞ্চম হিজরিতে নবীজি আকদ ও মোহর ছাড়াই তাকে গ্রহণ করেন। যাইনাব রা. অন্য স্ত্রীদের ওপর গর্ববোধ করতেন যে, আল্লাহ এ-বিবাহ আসমানে পড়িয়ে দিয়েছেন। [16.(বুখারি, হাদিস ৭৪২১)]  তিনি নয়টি হাদিস বর্ণনা করেন। নবীজির ইন্তেকালের পর সর্বপ্রথম বিশ হিজরিতে মদিনায় তার ইন্তেকাল হয়।

জুওয়াইরিয়া বিনতে হারেস মুসতালিকিয়া : ষষ্ঠ হিজরিতে বনি মুসতালিকের যুদ্ধে যুদ্ধবন্দি হিসেবে জুওয়াইরিয়া বিনতে হারেস মদিনায় আসেন। তিনি নবীজির কাছে মুক্তির সাহায্য চাইতে আসেন। তার বাবা ছিলেন গোত্রের সর্দার। নবীজি তাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। তিনি সম্মত হরে সাহাবিগণ তাদের হাতে থাকা বন্দিদের ছেড়ে দেন, যেহেতু তারা এখন নবীজির স. শ^শুর-সম্বন্ধীয় আত্মীয়। ফলে বনি মুসতালিকের শতাধিক সদস্য মুক্তি পায়। [17.(‘মিন মায়ীনিস সীরাত’, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৩০৩)]  তিনি ছিলেন মিষ্টি লাবণ্যময়ী চেহারার নারী। [18.(আবু দাউদ, হাদসি ৩৯৩১)] মোট পাঁচটি হাদিস তিনি বর্ণনা করেন। পঞ্চাশ হিজরিতে তার ইন্তেকাল হয়।

উম্মে হাবিবা বিনতে আবু সুফিয়ান : তিনি প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণ করেন। আবিসিনিয়ার দ্বিতীয় হিজরতে তিনি ও তার স্বামী আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশ উভয়ে শরিক ছিলেন। কিন্তু তার স্বামী সেখানে গিয়ে খ্রিষ্টান হয় এবং আবিসিনিয়ায় থাকতেই মারা যায়। ষষ্ঠ হিজরিতে নবীজি স. নাজ্জাশির মাধ্যমে তাকে বিবাহের প্রস্তাব পাঠান। নাজ্জাশি তাকে বিবাহ দিয়ে দেন এবং নিজের পক্ষ থেকে চারশত দিনার মোহর পরিশোধ করেন। বিবাহে তার অভিভাবক ছিলেন খালেদ ইবনে সায়িদ ইবনুল আস রা.। তার থেকে হাদিস বর্ণিত হয়েছে পয়ষট্টিটি। ৪৪ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

সাফিয়া বিনতে হুয়াই : মুসলমানরা সপ্তম হিজরিতে খাইবার বিজয়ে করেন যুদ্ধবন্দিদের হয়ে মদিনায় আসেন সাফিয়া বিনতে হুয়াই আখতাল। তিনি দাহিয়া কালবির রা. দাসী হন। অথচ তিনি ছিলেন কুরাইযা ও নাযির উভয় গোত্রের সর্দারের মেয়ে। জানতে পেরে নবীজি তাকে মুক্ত করে দেন এবং বিবাহ করে নেন। [19.(আবু দাউদ, হাদিস ৩৯৩১)]  এ-সময় নবীজি মদিনা ও খাইবারের মধ্যবর্তী একস্থানে অবস্থান করেছিলেন। খেজুর, পনির ও মাখন দিয়ে অলিমা আয়োজন করা হয়। [20(বুখারি, হাদিস ৫০৮৫)]

এর আগে সাফিয়া রা. স্ত্রী ছিলেন কেনানা ইবনে আবু হাকিক-এর; যে  খাইবার যুদ্ধে নিহত হয়েছে। তিনি মোট দশটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। ৫০ হিজরিতে রমজান মাসে তার ইন্তেকাল হয়।

মাইমুনা বিনতে হারিস হিলালিয়া : নবীজি তাকে বিবাহ করেন ওমরায়ে কাযা আদায় করতে গিয়ে [21.(বুখারি, হাদিস ৪২৫৯)]  খাইবার যুদ্ধের পরে সপ্তম বর্ষে। তিনিই নবীজির সর্বশেষ স্ত্রী।

তার বোন উম্মে ফযল লুবাবাতুল কুবরা ছিলেন নবীজির চাচা আব্বাস রা.-এর স্ত্রী এবং বৈপিত্রেয় বোন সালামা বিনতে উমাইস ছিলেন আরেক চাচা হামযা রা.-এর স্ত্রী। আব্বাস রা.-ই তাকে নবীজির স. সাথে বিবাহ করিয়ে দেন। [22.(আল-মাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যাহ, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৮৯)]  ওমরার সময় যেহেতু কুরাইশরা তাকে মক্কায় থাকতে অনুমতি দেয় নি, তাই সারাফ নামক স্থানে তার সাথে বাসর করেন। ৫১ হিজরিতে সেই সারাফেই ইন্তেকাল করেন। এর আগে তিনি আবু রহম ইবনে আব্দুল ওযযার স্ত্রী ছিলেন, যিনি মারা গেছেন। তিনি মোট বর্ণনা করেছেন ছিয়াত্তরটি হাদিস।