মনযূরুল হক
হাসির মতো কান্নাও মানুষের ব্যক্তিত্বের অন্যতম প্রকাশ। হাসি-কান্না মানুষের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এ-দুটি মানবতত্ত্বের এক নিগুঢ় রহস্য, যা কীভাবে ঘটে তা কেউ জানে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন— وَأَنَّهُ هُوَ أَضْحَكَ وَأَبْكَىٰ (তিনিই হাসান ও কাঁদান)। [1.(সূরা নাজম, আয়াত ৪৩)] মানুষের মাঝে হাসি-কান্নার উপাদান তিনিই সৃষ্টি করেছেন।
কান্নার ধরন
যদিও কান্নার অনেক ধরন হয়—ভয়ের কান্না, প্রেমের কান্না, বিরহের কান্না, আবেগের কান্না, অসহায়ত্বের কান্না, শোক ও বিষণ্নতার কান্না ইত্যাদি। রাসুল সা. স্বাভাবিক মানবীয় প্রকৃতির মতোই কোনো আত্মীয় ও প্রিয়জনের মৃত্যুতে কাঁদতেন। এ-ধরনের বহুঘটনা হাদিসের কিতাবে রয়েছে।
ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেন— রাসুল সা.-এর কান্না ছিলো হাসিরই অনুরূপ। তিনি শব্দ করে কাঁদতেন না, যেমন স্বশব্দে হাসতেন না। কেবল তার দু’চোখ অশ্রু ঝরাতো। [2.(জাদুল মায়াদ, খণ্ড ১, হাদিস ১৮৩)]
সন্তানের শোকে কান্না
আনাস রা. বলেন— আমি (নবী-পুত্র) ইবরাহিমকে দেখেছি নবীজির সামনে সামনে মৃত্যুপ্রায় অবস্থায়। নবীজির দু’চোখ গড়িয়ে পানি পড়তে লাগলো। তিনি বললেন, চোখ অশ্রু ঝরায়, হৃদয় বিষণ্ন হয়। আমার প্রতিপালক যে কথায় সন্তুষ্ট, তা-ই আমরা বলি। ইবরাহিম, তোমার বিচ্ছেদে আমরা ব্যথিত। [3.(বুখারি, হাদিস ১৩০৩)]
আনাস রা. বলেন— আমি নবীজির এক মেয়ের (দাফনের) সময় উপস্থিত ছিলাম। তিনি কবরের পাশে বসে ছিলেন। দেখলাম, তার দু’চোখ গড়িয়ে অশ্রু ঝরছে। [4.(বুখারি, হাদিস ১২৮৫)]
পরিবারের মৃত্যুতে কান্না
ওসামা ইবনে যায়েদ রা. বলেন— নবীজির কন্যা তার নিকট সংবাদ পাঠিয়েছেন, তার সন্তান মৃতপ্রায়। তিনি কয়েকজন সাহাবিসহ সেখানে গেলেন। শিশুটিকে নবীজির কোলে তুলে দেওয়া হলো, তখনো শিশুটির প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যাচ্ছে; (বর্ণনাকারী বলেন,) আমি ধারণা করছি তিনি বলেছিলেন— মনে হয় যেনো একটি চামড়ার পাত্র। তারপর তার দু’চোখ অশ্রু ঝরাতে লাগলো। সাদ রা. বললেন, আল্লাহর রসুল, এটা কী? নবীজি বললেন— এটাই মমতা, যা আল্লাহ তার বান্দাদের অন্তরে রেখেছেন। আল্লাহ তাআলা তার দয়ালু বান্দাদেরই দয়া করেন। [5.(মুসলিম, হাদিস ৯২৩)]
সাহাবিদের ভালোবাসায় কান্না
আনাস রা. থেকে বর্ণিত— রাসুল সা. যায়েদ ও তার সাথিদের শাহাদাতের সংবাদ দিয়ে বললেন, যায়েদ পতাকা তুলে নিয়েছে। সে শহিদ হলো। তারপর জাফর পতাকা ধরেছে। সে-ও শহিদ হয়ে গেলো। এবার আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা পতাকা হাতে নিয়েছে। সে-ও শহীদ হয়েছে। বর্ণনাকারী বলেন, নবীজির দু’চোখ তখন অশ্রু ঝরাচ্ছিল। [6.(বুখারি, হাদিস ৩০৬৩)]
কখনো তিনি এতো বেশি বেদনাহত হতেন যে, হৃদয়ে তার ছাপ তার থেকে যেতো। একসাথে অনেক ক্বারীর শাহাদাতের ঘটনা সম্পর্কে আনাস রা. বলেন— নবীজিকে এর চেয়ে বেশি বেদনাহত হতে আমি আর দেখি নি। [7.(মুসলিম, হাদিস ৬৭৭)]
নামাজে কান্না
নামাজে প্রায়ই নবীজিকে কাঁদতে দেখা যেত। কখনও সাহাবিরা জানতে পারতেন, কখনও বুঝতেও পারতেন না যে, নবীজি কাঁদছেন—কেবল তার দু’চোখ ছাপিয়ে অশ্রু ঝরে যেতো। আবার কখনও নামাজে তেলাওয়াতের সময় কান্নায় গলা ভারী হয়ে আসত।
আব্দুল্লাহ ইবনে শিখখির রা. তার পিতার বর্ণনা নকল করেন যে, একবার নবীজির কাছে গিয়ে দেখলাম, তিনি নামাজ পড়ছেন, আর তার বুক থেকে কান্নার এমন শব্দ বের হচ্ছে, যেন চুলায় রখা পানির পাত্র টগবগ করে ফুটছে।
কখনও আবার সেজদায় পড়েও কাঁদতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেন— একবার সূর্য গ্রহণের সময় নবীজি নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। দীর্ঘ রুকু-সেজদা করলেন। সেজদায় গিয়ে মনে হলো তিনি আর উঠবেন না। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন আর কাঁদছিলেন। দোয়ার মধ্যে বরছিলেন, হে আমার প্রতিপালক, আপনি কি আমাকে এই প্রুতশ্রুতি দেন নি যে, আমার উপস্থিতিতে উম্মতকে শাস্তি দেবেন না। [8.(নাসায়ি, হাদিস ১২১৪)]
কুরআন শ্রবণে কান্না
কুরআনে আজাবের আয়াত পাঠকালে কাঁদা নবীজির সুন্নাত ছিল। সাহাবিদের থেকে কুরআন তেলাওয়াত শুনেও তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. বলেন— নবীজি একদিন আমাকে বললেন, আমাকে কোরআন পড়ে শোনাও। ইবনে মাসউদ রা. বললেন, কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে আপনার ওপর আর আমি আপনাকে পড়ে শোনাব? নবীজী বললেন, আমি অন্যের কাছ থেকে শুনতে চাচ্ছি। ইবনে মাসউদ রা. সূরা নিসা তিলাওয়াত করলেন। যখন এ-আয়াতে এলেন, فَکَیْفَ اِذَا جِئْنَا مِنْ كُلِّ اُمَّۃٍۭ بِشَهِیْدٍ وَّجِئْنَا بِکَ عَلٰی هٰؤُلَآءِ شَهِیْدًا (তখন কী অবস্থা হবে, যখন আমি ডেকে আনব প্রত্যেক উম্মতের মধ্য থেকে সাক্ষী এবং আপনাকে ডাকব তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষীরূপে)। [9.(সূরা নিসা, আয়াত ৪১)] আমি দেখলাম নবীজির চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। [10.(বুখারি, হাদিস ৪৬৮২)]
আবেগ ও বিনয়ের কান্না
কিছু কিছু সময়ে নবীজীর মাঝে বিশেষ আবেগ ও বিনয় কাজ করত। তার মধ্যে অন্যতম হলো, হাজরে আসওয়াদ। নবীজী একবার হাজরে আসওয়াদ থেকে তাওয়াফ শুরু করলেন। ফিরে এসে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করলেন। তখন কান্নায় তার অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। [11.(বাইহাকি, হাদিস ৭২৩৪)]
এ-ছাড়া যখন আবু তালিব কাফেরদের পীড়াপীড়িতে নবীজিকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বললেন, তখনও তিনি চাচা আবু তালিবের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে কেঁদে ফেলেছিলেন। [12.(সহিহ ইবনে খুজাইমা, হাদিস ৩৬৭৫)]