মনযূরুল হক
নবীজির প্রতি সাহাবীদের এক ধরনের ভীতি কাজ করতো। মানুষের মধ্যে যে ভীতিকর প্রভাব থাকে, তা স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ভিন্ন দুটি রূপ লাভ করে। যদি এই ভয়ের সঙ্গে ভালোবাসার মিশেল থাকে তবে সেই ভীতিকে আমরা শ্রদ্ধাভীতি বলি। সাহাবিদের মধ্যে নবীজির ভালোবাসার প্রাবল্য থাকার ফলেই তাদের মধ্যে শ্রদ্ধাভীতি দেখা যেত। এই ভীতি তাদেরকে এমনভাবে ঘিরে রাখত যে, ভালোবাসা নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ত। অপর পক্ষে অমুসলিম ও মুশরিকরাও তাকে ভয় পেতো, কিন্তু তাতে ভালোবাসার পরশ না থাকায়, ভয়টাই তাদের মধ্যে প্রচণ্ড আকার ধারণ করত।
ভীতির এই দুটির রূপের সমর্থনে অনেক হাদিস পাওয়া যায়—
সাহাবিদের শ্রদ্ধাভীতি
একবার রসুল স. নারীদের বললেন বেশি বেশি সদকা করতে, কারণ তিনি মেরাজের রজনীতে দেখেছেন তাদের অধিকহারে জাহান্নামি হতে। সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এর স্ত্রী যয়নব রা. এই প্রসঙ্গে জানতে এলেন যে, এই সদকা স্ত্রী যদি স্বামীকে দেয়, তাহলে যথেষ্ট হবে কি না। তিনি এ সময়ে তিনি ভয়ে রাসুল সা.-এর ঘরের ভেতরে না গিয়ে তার দরজায় দাঁড়িয়ে বেলাল রা.-এর কাছে অনুরোধ করলেন যেনো তিনি বিষয়টির সমাধান এনে দেন। এরপর তিনি নিজেই বলেন, নবীজির স. মধ্যে শ্রদ্ধাভীতির উপাদান ঢেলে দেওয়া হয়েছে। [1.(বুখারি, হাদিস ১৪৬৬)]
একবার বদরি সাহাবী আবু মাসউদ রা. তার গোলামকে প্রহার করছিলেন, এ-সময় তিনি পিছন থেকে আওয়াজ শুনতে পেলেন— আবু মাসউদ, শোনো, তার ওপর তুমি যতটা ক্ষমতাবান, আল্লাহ তোমার ওপর তার চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান। রাগের কারণে কার আওয়াজ তা বুঝতে পারেন নি। আওয়াজকারী যখন আরও কাছে এসে বললেন— আবু মাসউদ, শোনো… তখন ফিরে তাকিয়ে দেখেন রসুল স.। আবু মাসউদ বলেন— ভয়ে আমার হাত থেকে লাঠি পড়ে গেলো। কোনোমতে বললাম, আল্লাহর ওয়াস্তে তাকে আমি আজাদ করে দিলাম। নবীজি বললেন— এটা না করলে জাহান্নামের আগুন তোমাকে ধরে ফেলতো। [2.(মুসলিম, হাদিস ১৬৫৯)]
নামাজে ভুল হওয়ার ব্যাপারে ‘যুল ইয়াদাইন’-এর হাদিসে এসেছে— নবীজি যোহর বা আসর নামাজে দুই রাকাত পড়ে সালাম ফেরালেন। এরপর উঠে গিয়ে তিনি মসজিদে রাখা একটি কাঠের কাছে গিয়ে হেলান দিলেন। লোকজন বলতে বলতে বের হলো, নামাজ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে আবু বকর ও ওমর রা.ও ছিলেন। কিন্তু তারা ভয়ে নবীজিকে কিছুই বলতে পারছিলেন না। এরপর সাহাবী ‘যুল ইয়াদাইন’ নবীজির সামনে গিয়ে কথাটি পাড়লেন। [3.( বুখারি, হাদিস ৪৮২)]
স্ত্রীদের শ্রদ্ধাভীতি
সর্বাধিক নৈকট্যপ্রাপ্ত সাহাবি আবু বকর ও ওমর রা.ও এমন ধরনের ভীতিতে তটস্থ ছিলেন। সন্দেহ নেই, এ ভীতি ভালোবাসা, সম্মান, ও শ্রদ্ধাবোধ থেকে সৃষ্ট। যদিও এই ভীতি তার নৈকট্য গ্রহণ ও কথাবার্তায় বিলকুল প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতো এমন নয়। বিশেষত তার স্ত্রীগণের ক্ষেত্রে তেমনটিই দেখা যায়।
সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. বলেন— একবার ওমর রা. নবীজির কাছে আসার অনুমতি চাইলেন। তখন তার কাছে তার কুরাইশি স্ত্রীগণ উপস্থিত ছিলেন। তারা উচ্চৈঃস্বরে তার কাছে নানান আবেদন করছিলেন। ওমর রা. যখন প্রবেশের অনুমতি চাইলেন, সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীগণ দ্রুত পর্দার আড়ালে চলে গেলেন। নবীজি স. তাকে অনুমতি দিয়ে হাসতে লাগলেন। ওমর রা. বললেন, আল্লাহর রসুল, আল্লাহ আপনাকে হাসিখুশি রাখুন। নবীজি বললেন, আমার কাছে যারা ছিল তাদের ব্যাপারে আশ্চর্য হচ্ছি। তোমার আওয়াজ শুনে তারা পর্দার আড়ালে চলে গেলো। ওমর রা. বললেন, আল্লাহর রসুল, তাদের উচিত ছিলো আপনাকে ভয় পাওয়া। তিনি আরও বললেন, হে নিজেদের নফসের শত্রুরা, তোমরা আমাকে ভয় পাচ্ছ অথচ রসুলকে স. ভয় করছো না? তারা বললেন, কারণ আপনি রসুলের স. চেয়ে রুঢ় ও কঠিন। [4.( বুখারি, হাদিস ৩২৯৪)]
স্ত্রীদের কথা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, ওমরের প্রতি তাদের ভীতি ছিল ত্রস্ত হবার মতো, আর রসুল স.-এর প্রতি তাদের ভীতি ছিলো শ্রদ্ধাপূর্ণ।
কাফেরদের ভীতি
এ-বিষয়ে দুটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়—
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন, তিনি নাজদ এলাকায় নবীজির সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধ শেষে নবীজি স. ফিরে এলে তিনিও তার সঙ্গে ফিরলেন। পথিমধ্যে দুপুরে কাঁটাগাছ ভরা এক উপত্যকায় তাদের ভীষণ গরম অনুভূত হলো। নবীজি স. এখানেই নেমে পড়লেন। লোকজন ছায়াদার বৃক্ষের খোঁজে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এদিকে নবীজি স. একটি বাবলা গাছের নিচে অবস্থান করে তার তরবারিখানা গাছে ঝুলিয়ে রাখলেন। জাবির রা. বলেন— সবেমাত্র আমরা ঘুমে গিয়েছি। এমন সময় নবীজি স. আমাদের ডাকতে লাগলেন। আমরা হাজির হলাম। দেখি তাঁর কাছে এক বেদুইন বসা। নবীজি স. বললেন— আমি ঘুমে ছিলাম। এমতাবস্থায় সে আমার তরবারিটি হাতে নিয়ে কোষমুক্ত অবস্থায় তা আমার উপর উঁচিয়ে ধরল। সহসা আমি জেগে যাই। সে আমাকে বলল— এখন তোমাকে আমার হাত থেকে কে বাঁচাবে? আমি বললাম— আল্লাহ। দেখ না, এ-ই তো সে বসে আছে। নবীজি স. তাকে কোনো শাস্তি দিলেন না। [5.(বুখারি, হাদিস ৪১৩৫)]
উহুদ যুদ্ধে আরেকটি ঘটনা ঘটে মক্কার প্রসিদ্ধ কাফের উবাই ইবনে খালাফের সঙ্গে। যুদ্ধ শেষে আহত নবীজিকে নিয়ে পর্বতের ঘাঁটিতে ছিলেন আবু বকর, ওমর, আলী, তালহা ও যুবাইর প্রমুখ সাহাবি রা.। এ-সময় উবাই ইবনে খালাফ সেখানে পৌঁছে বলল— মুহাম্মাদ, এ যাত্রা তুমি বেঁচে গেলেও তোমার নিস্তার নেই। মুসলমানগণ বললেন— আল্লাহর রসুল, লোকটিকে সহানুভূতি দেখানো কি আমাদের উচিত হবে? নবীজি স. বললেন— ওকে আসতে দাও।
সে কাছে এলে নবীজি হারেস ইবনে সিম্মারের কাছ থেকে একটি বর্শা নিলেন। কোনো কোনো বর্ণনানুসারে, বর্শা হাতে নিয়ে নবীজি এমন ভীতিকর প্রভাব দেখালেন যে, উট প্রবল জোড়ে নড়ে উঠলে তার পিঠে বসা বিষাক্ত ভিমরুলের ঝাঁক যেমন ছত্রভঙ্গ হয়ে উড়ে যায়; আমরাও ঠিক তেমনি ভয়ে তাঁর কাছ থেকে দূরে সটকে পড়লাম। নবীজি উবাইয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং তার শিরস্ত্রাণ ও গায়ের বর্মের মধ্যে সামান্য একটু যে জায়গা ফাঁকা ছিল, সেখানে বর্শার আঘাত হানলেন। তাতেই উবাই ইবনে খালাফ তার ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়লো এবং বেশ কয়েকবার গড়াগড়ি খেলো।
এর আগে উবাই মক্কায় নবীজির সাথে দেখা হলেই বলত— মুহাম্মাদ, আমার একটা ঘোড়া আছে। তার নাম ‘আওজ’। তাকে আমি প্রতিদিন ৪০ কেজি ভুট্টা খাওয়াই। এই ঘোড়ায় চড়ে একদিন তোমাকে হত্যা করব। নবীজি একদিন জবাব দিলেন— বরং আল্লাহ চাহেতো আমিই তোমাকে হত্যা করব।
উবাইয়ের কাঁধে জখমটি তেমন গুরুতর না হলেও তা দিয়ে রক্ত ঝরছিল। সে কুরাইশদের কাছে ফিরে গিয়ে বলল— আল্লাহর কসম, মুহাম্মাদ আমাকে হত্যা করেছে। কুরাইশরা বলল— আসলে তুমি অতিমাত্রায় ঘাবড়ে গেছ। জখম সামান্য; তোমার কোনো ভয় নেই। সে বলল— মক্কায় থাকাকালেই মুহাম্মাদ আমাকে বলেছিল, তোমাকে আমিই হত্যা করব। আমার আশঙ্কা, সে যদি আমার প্রতি শুধু থুথুও নিক্ষেপ করে তা হলেও আমি মরে যাব। কুরাইশরা তাকে নিয়ে মক্কায় রওয়ানা হলে পথিমধ্যে সারেফ নামক স্থানে সে মারা যায়। [6.(ইবনে হিশাম, উহুদ যুদ্ধ অধ্যায়, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১৯)]