নবীজি : কাফেরদের সাথে তার সম্পর্ক

ইফতেখার জামিল

মুসলমানদের সাথে অমুসলিমদের সম্পর্ক কেমন হবে, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।  এই প্রশ্নের সাথে অনেক কিছুই জড়িত।সমাজ,রাজনীতি, জাতীয়-আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং সংস্কৃতি ও মানবাধিকারসহ অনেক প্রশ্নও এর সাথে জড়িত। বহুল আলোচিত উদারতা ও কঠোরতার বিতর্কও এর সাথে জড়িত।   ‘সে তো উদারপন্থী বা চরমপন্থী’ এই কথাগুলো আমাদের মাঝেমাঝেই শুনতে হয়। শুনে আমরা ভাবতে বসি, কথাটার ভিত্তিটা কী? সবচে বড় কথা,   ঈমান ও কুফুরের সামাজিক সম্পর্ক ও সক্রিয়তা কী ও কেমন হবে, এই আলোচনায় এর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। অবশ্য পক্ষ,বিপক্ষ ও নিরপেক্ষ  ব্যাখ্যা তো অনেকেই দেয়। আমরা নবীজির জীবন থেকে এটা বুঝার চেষ্টা করবো। [1.৩০-৩৯ ফিকহুস সিরাহ, রামাজান বুতি]

 

১) নবীজি কুফুরের কেন বিরোধিতা করতেন ? এই আলোচনায় এটাই সবচে কেন্দ্রীয় প্রশ্ন। কাফেরদের সাথে নবীজির কোন ব্যক্তিগত বিরোধিতা ছিলোনা। সামাজিক প্রভাব বিস্তারের আশাতেও নবীজি তাদের বিরোধিতা করেন নি। নিছক ভিন্নমতের কারণেও নবীজি তাদের বিপক্ষে যান নি। অর্থাৎ কাফেরদের বিরোধিতার নির্দিষ্ট অর্থ ও মর্ম আছে। ইসলাম অর্থহীন ও অযৌক্তিক ধর্ম নয়। বরং পবিত্র কোরআনে অর্থহীনতা ও অনর্থকতার ব্যাপক নিন্দা জানানো হয়েছে। [2.১৯১ সূরা বাকারা,  ৮৫ সূরা হিজর, ১৬ সূরা আম্বিয়া ]  ফলে, অবশ্যই,  কাফেরদের বিরোধিতায় ইসলামের নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা আছে। [3. ৩৩ সূরা ফুরকান, ১১১ সূরা ইউসুফ, ৬৪ সূরা নাহাল]

 

এক ইহুদী বালক নবীজির সেবা করতো। নবীজি খুশীমনে তার সেবা গ্রহণ করতেন।হঠাৎ বালক অসুস্থ হয়ে পড়ল। মৃত্যুপ্রায় অবস্থা। নবীজি তাকে দেখতে গেলেন। বললেন, বাবা, ঈমান নিয়ে আসো। বালক তার নিজের বাবার দিকে তাকাতে লাগলো। তার বাবা বললেন, মোহাম্মদ যা বলছে, ইসলাম গ্রহণ করো।[4.১৩৫৬ বুখারি। ৪/ ৪৫ মাজমাউয যাওয়ায়েদ।৫৭৩৬  মিশকাতুল মাসাবিহ]   এই ঘটনায় পরিষ্কার যে, নবীজি ব্যক্তিগত  কারণে কুফুরের  বিরোধিতা করতেন না। ব্যক্তিগত কারণে বিরোধিতা করলে ইহুদী বালককে  সেবা করার সুযোগ দিতেন না। মৃত্যুপ্রায় অবস্থায়  ইসলামের দাওয়াত নিয়ে যেতেন না। কুফুর মানে ব্যক্তিগত ভালো-খারাপ নয়। কুফুরের বিরোধিতা মানে ব্যক্তিগত বিরোধিতা নয়। কুফুরের বিরোধিতার আরও গভীর মর্ম আছে।

 

মক্কায় ইসলাম ছড়িয়ে পড়ছে। কুরায়শের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হামযা পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করে ফেলেছেন। কুরাইশদের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ছে। এর প্রেক্ষিতে কুরাইশের নেতৃবর্গ উতবা বিন রবিয়াহকে নবীজির কাছে পাঠালো। উতবাহ ছিল শান্ত,গম্ভীর ও বিচক্ষণ প্রকৃতির মানুষ। উতবাহ নবীজির কাছে এসে বললো, দ্যাখো ভাতিজা, আমরা তোমার বংশীয় মর্যাদার কথা জানি। তুমি যে বিশৃঙ্খলা ও অনৈক্য সৃষ্টি করছ, তা ঠিক হচ্ছেনা। তোমার কি লাগবে বলো। অর্থ লাগবে? ক্ষমতা লাগবে? তুমি কী যেন আসতে দ্যাখো, আমরা এর চিকিৎসাও করে দেবো। খরচ ও চিকিৎসক নিয়েও তোমার চিন্তা করতে হবেনা। নবীজি বললেন, চাচা একটু বসুন। আমি আপনাকে কোরআনের কয়েকটা আয়াত শুনিয়ে দেই , , [5. ১/ ১৯৩ ইবনে হিশাম। ১৮৭ লুবাবুল মানকুল]

 

এর অর্থ কী দাড়ায়? নবীজি অর্থ-সম্পদ লাভের জন্য কাফেরদের বিরোধিতা করতেন না। ক্ষমতা লাভের জন্যও কাফেরদের বিরোধিতা করতেন না। সামাজিক ঐক্যের জন্যেও নবীজি কাফেরদের বিরোধিতা করতেন না। কেননা কুরাইশরা নবীজিকে অর্থ-সম্পদ দেবার জন্য প্রস্তুত ছিল। ক্ষমতা দেবার জন্য প্রস্তুত ছিল। আপাত দৃষ্টিতে নবীজির দাওয়াতে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অনৈক্যও সৃষ্টি হচ্ছিল। তবুও নবীজি ঈমানের দাওয়াত দিয়ে গিয়েছেন।[6.ঐ]    কুফুরের বিরোধিতা করে গিয়েছেন। তাহলে কুফুর বিরোধিতার মর্মটা কী?

 

এই মর্মটা বুঝা অত্যন্ত জরুরী। এটাই ঈমান ও কুফুরের সম্পর্কের মানদণ্ড। উদারতা ও কঠোরতার মধ্যে পার্থক্য। একইভাবে ঈমান ও কুফুরের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য বিষয়ক বক্তব্যও বটে।

 

২) কোরআনে আল্লাহ পাক কাফেরদের সাথে মোকাবেলার কারণ হিসেবে বলেছেন, ফিতনা থেকে রক্ষা পাবার জন্য তোমাদের কাফেরদের মোকাবেলা করতে হবে।[7.১৯০-১৯৩ সূরা বাকারা। ৩৯ সূরা আনফাল]   ফিতনা মানে কী? আক্ষরিকভাবে ফিতনা মানে হচ্ছে, পরীক্ষা, বিশৃঙ্খলা ও ভ্রষ্টতা। [8.৪৮১ আল মুফরাদাত ফি গরিবিল কোরআন।  ৪৭২-৭৩ মাকাঈসুল লুগাহ। ৬৯২ কুল্লিয়াত কাফাবি]  পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলা মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য পাঠিয়েছেন। মানুষের চারদিকে বিশৃঙ্খলা ও ভ্রষ্টতা ছড়িয়ে থাকবে। মানুষকে এর মধ্যেই পরীক্ষা দিতে হবে। বিশৃঙ্খলা ও ভ্রষ্টতা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। আল্লাহ মানুষকে ক্ষমতা দিয়ে পাঠিয়েছেন। মানুষ পরীক্ষায় সফল হবার ক্ষমতা রাখে। আবার ভ্রষ্ট হবারও ক্ষমতা রাখে। অন্যকে ভ্রষ্ট হতে অনুপ্রাণিত করারও ক্ষমতা রাখে। আবার ভ্রষ্টতা মোকাবেলা করারও ক্ষমতা রাখে। [9. ৩/২৯২-২৯৪ তাফসিরে ইবনে জারির।১/৫২৪-২৫  ইবনে কাছির । ২/ ২০২ ইবনে আশুর]  এর একটু ব্যাখ্যা করা যাক।

 

আল্লাহ মানুষকে  বুদ্ধি, জ্ঞান, ক্ষমতা, ইচ্ছা ও শক্তির মত গুণ দান করেছেন। এগুলো মূলত আল্লাহর ছিফাত।ছিফাতে রুবুবিয়াত। মহামহিমের গুণাবলী। মানুষকেও রুপক অর্থে এই গুণগুলো দেওয়া হয়েছে। এই জন্যেই মানুষকে খলিফা বা প্রতিনিধি বলা হয়। এবং মানুষ এগুলোর মাধ্যমেই ন্যায়-অন্যায়ে পার্থক্য করতে পারে। ন্যায় ও অন্যায় সম্পাদন করতে পারে। এক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ করাই ঈমান এবং আনুগত্য করতে অস্বীকার করাই কুফুর।  এর কারণেই মানুষের বুদ্ধি, জ্ঞান, ক্ষমতা, ইচ্ছা ও শক্তির ভ্রষ্টতা সৃষ্টি হয়। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। জুলুম সৃষ্টি হয়। এভাবে কুফুর অন্য সকল মানুষের জন্য পরীক্ষা হয়ে উঠে। ফিতনা হয়ে উঠে। এর মোকাবেলা করার জন্যই নবীজি কুফুরের বিরোধিতা করেছেন এবং করার নির্দেশ দিয়েছেন। [10.৬৫-৬৯ কুবরাল ইয়াকিনিয়াত আল কাওনিয়াহ, রামাজান বুতি]

 

কী বুঝা গেল? বুদ্ধি, জ্ঞান, ক্ষমতা, ইচ্ছা ও শক্তির ভ্রষ্টতার মূলে আছে কুফুরি। এই ভ্রষ্টতা আর কুফুরি একে অপরের সম্পর্কযুক্ত। কোরআন ও সুনানে এ কারণেই কুফুরের বিরোধিতা করা হয়েছে। কাফেরদের বুদ্ধি, জ্ঞান, ক্ষমতা, ইচ্ছা ও শক্তির ভ্রষ্টতার সমালোচনা করা হয়েছে। মোকাবেলা ও বিরোধিতা করতে বলা হয়েছে। নবীজির জীবনের মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা করা যাক।

 

৩)  নবীজি কাফেরদেরকে ব্যক্তিগতভাবে ঘৃণা করতেন না। কাফেরদের মানবিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করতেন না। বরং তার কুফুরি সংশোধন করতে চাইতেন। কুফুরিকে ব্যক্তির মধ্যে সীমিত করতে চাইতেন। এবং কুফুরির  বুদ্ধি, জ্ঞান, ক্ষমতা, ইচ্ছা ও শক্তিভিত্তিক প্রতিক্রিয়ার শক্ত সমালোচনা করতেন। সূরা মুমতাহিনার মধ্যে সংক্ষিপ্তভাবে এটাই বলা হয়েছে। ‘ ধর্মের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি এবং তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিস্কৃত করেনি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালবাসেন।’ [11.৮-৯ সূরা মুমতাহিনাহ]   সূরা বাকারার মধ্যে আল্লাহ বলেছেন, ধর্মগ্রহণে কোন জোর-জবরদস্তি নাই। [12.২৫৬ সূরা বাকারা]  এর অংশ হিসেবে ভিন্ন ধর্মের কারো মানবিক অধিকারেও হস্তক্ষেপ করা যাবেনা। [13.৩০৫২ আবু দাউদ। ৩৯৭৬  মেশকাতুল মাসাবিহ] তবে তার সামাজিক সক্রিয়তাকে বাঁধা দিতে হবে। [14.২৬৫৮ মুসলিম।১৩৫৮ বুখারি] হাদিসুল ফিতরাহ এর মধ্যে এটাই বলা হয়েছে। বস্তুত প্রত্যেকেই সুস্থ মানবিক গুণাবলীর সাথে ইসলাম গ্রহণ করার ক্ষমতা নিয়েই জন্ম গ্রহণ করে। পরবর্তীতে সামাজিক পরিবেশ ও প্রতিবেশের প্রভাবে তার মধ্যে ভ্রান্তি আসে। এটাই ফিতনার প্রভাব। একে ইসলাম মোকাবেলা করার চেষ্টা করে। এটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতিনিধিত্ব। আরবিতে একেই খেলাফত বলা হয়ে থাকে। [15.১৪ সূরা বাকারা। ৫৫-৫৭ সূরা নূর]   জিহাদ এর সাথেই সংশ্লিষ্ট। [16.৩/৩৩৬ হাশিয়াতু ইবনে আবেদিন। ৪৬ আল জিহাদু ওয়াল কিতালু ফিস সিয়াসাতুশ শারিঈইয়াহ। ৫১৩ বিদায়াতুল মুজতাহিদ]

 

আবু তালেব নবীজিকে অনেক সাহায্য করেছেন। তবুও নবীজি তার প্রতি সন্তুষ্ট হন নি। তাকে নিয়মিত দাওয়াত দিয়ে গেছেন। মৃত্যুর আগেও ঈমান আনার অনুরুধ করেছেন। [17.১৩৬০ বুখারি। ২০৩৪ নাসাঈ]  যদি নিছক ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক কারণে কাফেরদের বিরোধিতা করা হত, তাহলে তো নবীজি আবু তালেবকে দাওয়াত দিতেন না। যে ইহুদী বালক নবীজির সেবা করতো তাকেও ঈমানের দাওয়াত দিতেন না।কেননা তারা তো নবীজির ব্যক্তিগতভাবে প্রিয় ছিল। রাজনৈতিকভাবেও বিরোধী ছিল না।

 

বদরের ময়দানে নবীজি সাহাবাদের নিয়ে চলা শুরু করলেন। কাফেরদের সাথে মুসলমানদের প্রথম মোকাবেলা। মুসলমানরা শক্তিতে ও সংখ্যায় অনেক কম। ইতোমধ্যে এক কাফের পালোয়ান নবীজির কাছে এসে বলল, মোহাম্মদ আমি তোমাদের সাহায্য করতে চাই। সাহাবারা তার কথায় আনন্দিত হয়ে উঠলেন। নবীজি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি মুসলমান? লোকটি বলল, আমি মুসলমান নই। নবীজি বললেন, যাও, আমাদের কোন কাফেরের সাহায্য লাগবেনা। [18. ১৮১৭ মুসলিম। ২৭৩২ আবু দাউদ] নবীজি কেন কাফেরের সাহায্য গ্রহণ করেন নি। কেন করেন নি?

 

নবীজি তো আসলে ব্যক্তি কাফেরদের মোকাবেলা করতে যাচ্ছিলেন না। রাজনৈতিক ক্ষমতার মোকাবেলাও করতে যাচ্ছিলেন না। বরং কুফুরির মোকাবেলা করতে যাচ্ছিলেন। তাদের  বুদ্ধি, জ্ঞান, ক্ষমতা, ইচ্ছা ও শক্তির ভ্রষ্টতা ও প্রতিক্রিয়ার মোকাবেলা করতে যাচ্ছিলেন। এই মোকাবেলায় আরেক কাফের থেকে কীভাবে সাহায্য গ্রহণ করতে পারেন? [19.২২-২৫ আল আকিদা ওয়াল ইবাদাহ, আলী নাদাবি]

 

৪) নবীজি কাফেরদের মানবিক অধিকারের কথা বলেছেন, এটা শুনলেই অনেকে নাক সিটকায়। অতিউদারতা বলে মন্তব্য করে। অথচ এটাও আমাদের ধর্মের অংশ।কোন কাফের যদি মুসলিম রাষ্ট্রে এসে কুফুরি ব্যক্তির মধ্যে সীমিত রেখে ব্যাস করতে চায়, তাতে অসুবিধা নেই। এমনিভাবে অমুসলিম রাষ্ট্রও মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বের চুক্তি করতে পারে। নিজের রাষ্ট্রের মধ্যেই কুফুরি সীমিত রাখার কথা বলতে পারে। ইসলাম ঐ কাফের ব্যক্তির মানবিক অধিকার নিশ্চিত করবে। ঐ কাফের রাষ্ট্রের সাথে নিরাপত্তা সমস্যায় যুক্ত হবেনা। [20.৫১৭ বিদায়াতুল মুজতাহিদ]

 

নবীজি বলেছেন, যে আশ্রিত কাফের ব্যক্তির ওপর জুলুম করবে, তার অধিকার কেড়ে নিবে, তার ওপর অস্বাভাবিক বোঝা চাপাবে বা  সন্তুষ্টি ব্যতীত তার কোন সম্পদ কেড়ে নিবে, সে জান্নাতের ঘ্রাণ পাবেনা। কেয়ামতের দিন আমি তার বিপক্ষে দাঁড়াবো। এভাবে নবীজি তার অধিকার রক্ষার বিষয়ে শক্ত নির্দেশনা জারি করেছেন।তাদের নিরাপত্তা, সম্পদ ও মানবিকতার রক্ষার গুরুত্ব আরোপ করেছেন। [21.৩০৫২ আবু দাউদ। ৩৯৭৬  মেশকাতুল মাসাবিহ।  ৬৯১৪ বুখারি। ২১৯২ ইবনে মাজাহ]

 

বদরে সত্তর জন কাফেরকে বন্দী করে আনা হয়। নবীজি তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করার নির্দেশ দেন। [22.১৭৬৩ মুসলিম। ৪৭৯৩ ইবনে হিব্বান]  মৃত্যুর আগে নবীজির কিছু টাকার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। নবীজির কাছে টাকা ছিলোনা।এক ইহুদীর কাছ থেকে ঋণ নিলেন। বন্ধক হিসেবে তার কাছে বর্মটাও রেখে আসলেন। এভাবে ঋণ আদায়ের নিশ্চয়তাও প্রদান করেছেন। অথচ নবীজি তখন আরবের প্রধান ব্যক্তিত্ব। তবুও অধিকার রক্ষার জন্য ইহুদীর কাছেও বন্ধক রেখেছেন। [23.৪৬২৪ সুনানে নাসাঈ। ২০৬৯ বুখারি] হুজাইফা বিন ইয়ামান এবং তার পিতাকে কাফেররা যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার শর্তে মুক্তি দিয়েছিল। বদর যুদ্ধের আগে তারা মদিনায় এসে পৌঁছে। নবীজি শর্তের কথা জানতে পারেন। এবং যুদ্ধ অংশ গ্রহণ করতে বাঁধা দেন। [24.১৭৮৭ মুসলিম। ৮/ ২১৩ আল মু’জামুল আওসাত]

 

মদিনায় এসেই নবীজি সকল গোত্র ও পক্ষের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। আবার নির্দিষ্ট কিছু শর্তের ভিত্তিতে নবীজি মক্কার কাফেরদের সাথে হুদায়বিয়ায় বিশেষ চুক্তিতেও আবদ্ধ হন। এভাবে কুফুরির নিয়ন্ত্রণের শর্তে নবীজি কাফেরদের সাথেও চুক্তি করেছেন। [25.৩৪০৯  আবু দাউদ। ২১৬৫ বুখারি]  এভাবে নবীজি  কুফুরি সংশোধন করতে চাইতেন। কুফুরিকে ব্যক্তির মধ্যে সীমিত করতে চাইতেন। সীমিত রাখতে পারলে তাদের সাথে সরাসরি বিরোধিতায় যেতেন না। এবং কোন অবস্থাতেই কাফেরদেরকে ব্যক্তিগতভাবে ঘৃণা করতেন না। তাদেরকে ব্যক্তিগত ও মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতেন না।

 

আজকাল মুসলমানদের মধ্যে এই চেতনা লোপ পেয়েছে। তারা কাফেরদেরকে ব্যক্তিগতভাবে ঘৃণা করে।তাদের ব্যক্তিগত মর্যাদা কেড়ে নিতে চায়। তাদের মানবিক অধিকার কেড়ে নিতে চায়। অথচ তাদের কুফুরির  বুদ্ধি, জ্ঞান, ক্ষমতা, ইচ্ছা ও শক্তিভিত্তিক প্রতিক্রিয়াকে মেনে নেয়। বরং অনেক সময় অনুসরণও করে।

 

৫) মুসলিম ও অমুসলিমরা এক সমাজে থাকতে পারবে? অবশ্যই পারবে। ব্যক্তিগতভাবে মুসলিম ও অমুসলিম সকলের অধিকার নিশ্চিত করতে ইসলাম নির্দেশ দেয়। নিরাপত্তা,সুরক্ষা ও মানবিক মর্যাদা রক্ষার জোর তাগিদ দেয়। এভাবে  ঐতিহাসিক ভাবে দেখা যায়, মুসলমানদের বিজয়ের মাধ্যমে মিসর ও সিরিয়ায় ইহুদী ও খৃস্টানরা লাভবান হয়েছে। নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ হয়েছে। ফলে তারা মুসলমানদের বিজয়কে স্বাগত জানিয়েছে। সমর্থন করেছে। [26.গাইরুল মুসলিমীন ফিশ শারিআতিল ইসলামিয়াহ, ইউসুফ আল কারজাবি]

 

আবার ইহুদী ও খৃস্টান নাগরিকদের মাধ্যমে মুসলমানরাও উপকৃত হয়েছে। ইহুদী ও খৃস্টান ছিল ভিন্ন সভ্যতার সন্তান। তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড ছিল, অভিজ্ঞতা ও চর্চা ছিল, যার থেকে মুসলমানরা নানাভাবে উপকৃত হয়েছে। একদল দক্ষ পেশাজীবী, ব্যবসায়ী ও শিক্ষক পেয়েছে। এর মাধ্যমেই মুসলিম সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। ইসলাম মানুষের বুদ্ধি, জ্ঞান, ক্ষমতা, ইচ্ছা ও শক্তিকে গুরুত্ব দেয়। যথাযথ মর্যাদা দান করে। কেননা সবাই তো আল্লাহর বান্দা। অমুসলিমদের বুদ্ধি, জ্ঞান, ক্ষমতা, ইচ্ছা ও শক্তিও মূলত আল্লাহর কুদরতের তাজ্জাল্লি। এই গুণগুলো কুফুরের রোগ থেকে বেঁচে থাকলে ইসলাম তার থেকে অবশ্যই উপকৃত হতে বলে।[27.৬৫-৬৯ কুবরাল ইয়াকিনিয়াত আল কাওনিয়াহ, রামাজান বুতি]

 

নবীজি হিজরতের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অন্যদিকে মক্কার কুরাইশরাও হিজরত ঠেকানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। নবীজির সামনে কঠিন সময়। মক্কা থেকে মদিনায় যেতে হবে। মরুভমির পথ। পেছনে শত্রু রেখে গন্তব্যে পৌঁছতে হবে। নানাভাবে শত্রুকে ফাঁকি দিতে হবে। কীভাবে এটা করা সম্ভব? নবীজি বনু দাইল গোত্রের এক ব্যক্তির সাথে চুক্তি করলেন। সে যদিও কাফের ছিল, তবুও নবীজি তার সাহায্য নেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। এবং তার মাধ্যমেই মদিনা পৌছলেন। এভাবে নবীজি কাফেরদের দক্ষতার সহায়তায় নিয়েছেন। অর্থনৈতিক চুক্তি ও লেনদেনে জড়িয়েছেন। [28.২২৬৩, ৩৯০৫ বুখারি]

 

তবে একসাথে থাকতে বাঁধা না থাকলেও দুটি বিষয়ে বাঁধা আছে। এক, রাজনৈতিকভাবে কাফেরদের আনুগত্য করা যাবেনা। কেননা এতে তাদের কুফুরি গুণাবলীর সমর্থন প্রকাশ পায়। এবং এতে কুফুর উৎসাহিত হয়। ভ্রান্তি, ভ্রষ্টতা ও বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায়। এ কারণেই সূরা মায়েদার পঞ্চান্ন আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, শুধু মাত্র আল্লাহ, আল্লাহর রসূল ও মুমিনদের আনুগত্যই করতে হবে। ঈমানের প্রতি মোহাব্বত ও কুফুরের প্রতি ঘৃণা রাখতে হবে।[29.৫৪-৫৬ সূরা মায়েদা]   এর অংশ হিসেবে কাফেরদের অনুষ্ঠানে শরীক হওয়া যাবেনা। তাদের বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করা যাবেনা। কেননা নবীজি বলেছেন, যারা কোন সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করে, তারা তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।[30.৪০৩১ আবু দাউদ। ৪৩৭ বুলুগুল মারাম] নবীজি যখন মদিনায় আগমন করেন, তখন মদিনাবাসীর বাৎসরিক দুটি উৎসব ছিল। নবীজি তার পরিবর্তে নতুন দুটি উৎসব প্রবর্তন করেন। পূর্বের উৎসব বাতিল করেন।[31.১১৩৪ আবু দাউদ। ১৩৮  বুলুগুল মারাম]

 

৬) নবীজির সাথে কাফেরদের সম্পর্ক কেমন ছিল, এই প্রশ্নের সরল কোন উত্তর নেই। অনেকগুলো চিত্র আছে। পরিস্থিতি, পরিবেশ ও প্রতিবেশের পর্যালোচনা আছে। এবং তার ভিত্তিতেই নবীজি কাফেরদের সাথে আচরণ করেছেন, তাদের সাথে সম্পর্ক রেখেছেন। আচরণ ও সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এভাবে শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি আল্লাহর আনুগত্যের উত্তম নমুনা স্থাপন করে গেছেন। নিশ্চয় নবীজির জীবনের মধ্যেই আছে আমাদের জন্য উত্তম নমুনা ও দৃষ্টান্ত। [32.২১  সূরা আহযাব]