পশু-পাখির প্রতি দয়া

শুধু স্বজাতির প্রতি দয়া, স্ববিশ্বাসীদের প্রতি অনুরাগ কিংবা শুধু মানুষের প্রতি ভালোবাসা নিয়েই তিনি এই পৃথিবীর বুকে আসেননি, তিনি রহমতুল্লিল আলামিন—সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য তিনি রহমত ও দয়ার প্রতিরূপ হয়ে এসেছিলেন। সকল সৃষ্টির প্রতিই বিছানো ছিলো তাঁর দয়ার অবারিত চাদর। হাওয়ায় উড়ে বেড়ানো পাখিরা তাঁকে বুঝতো; নিজেদের অক্ষম ভাষায় ফরিয়াদ জানাতো তাঁর কাছে। তাঁর দয়া ও মমতার মখমলে উষ্ণতা পেতো বনের হরিণ, মরুভূমির উট। তাঁর জন্য কেঁদে জারজার হয়েছিলো মসজিদে নববীর খেজুরশাখা। মেঘেরা তাঁর জন্য উড়তো এক খণ্ড ছায়ার আরাম হয়ে। তাঁর মমতার ধারায় সংলগ্ন ছিলো বিশ্বজগত। এই সংলগ্নতার টের অবলা প্রকৃতির গায়ে নানা সাংকেতিক ভাষায় তাঁর দয়ার প্রতি কুর্ণিশ জানাতো, কৃতজ্ঞতার কথা বলতো।

তিনি প্রাণীদের প্রতি দয়ার কথা বলতেন। সাহাবীদের শেখাতেন শুধু মানুষের প্রতিই নয়, সৃষ্টির ক্ষুদ্রতম যে সৃষ্টি, তার প্রতিও করতে হবে দয়ার আচরণ। কেউ জীবের প্রতি অন্যায় করলে তিনি মন খারাপ করতেন, কষ্ট পেতেন; রাগ করতেন, অভিশাপ দিতেন। জীব-জন্তুর অক্ষম কান্না তাঁকে ব্যথিত করতো।

প্রাণীদের ব্যাপারে সাহাবীদেরকে সতর্ক করে একবার রাসূলে কারীম সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘জনৈকা নারী একটি বিড়ালকে আটকে রেখেছিলো। আটকে থাকা অবস্থায় বিড়ালটি মারা যায়। এজন্যই ওই নারীকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়েছিলো।’

স্বাভাবিক সমন্বয়তার প্রতি ছিলো তাঁর সজাগ দৃষ্টি। প্রাণীদের প্রতি অমানবিক আচরণের প্রতি যেমন ছিলো তাঁর দয়ার্দ্র হৃদয়, সতর্ক হেদায়েত ও নির্দেশনা, ঠিক তেমনি প্রাণীদের নিয়ে অহেতুক জীবনবিঘ্নিত বাড়াবাড়িকেও তিনি প্রশ্রয় দেননি। দিন-রাতের ব্যস্ততা যাদের পশু-পাখির পেছনে ব্যয়িত, তাদেরও তিনি সতর্ক করেছেন। এর খারাপ দিক সম্বন্ধে সজাগ করেছেন। কোনো প্রাণীর ভালো দিক যেমন বর্ণনা করেছেন, তেমন বিবরণ দিয়েছেন প্রাণীদের ক্ষতিকর ব্যাপার সম্পর্কেও।

তিনি সাহাবীদের উদ্দেশে আরেকবার একটি ঘটনা শোনান। বলেন, একদা এক লোক রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছিলো। পথে তাঁর খুব পিপাসা পেলো। সহসা একটি কূপ দেখতে পায় সে। তাতে নেমে পড়ে। পানি পান করে। তারপর ওখান থেকে বেরিয়ে আসে। হাঁটতে-হাঁটতে দেখে একটি কুকুর জিভ বের করে হাঁফাচ্ছে। ঘন হয়ে শ্বাস ওঠানামা করছে কুকুরটির। তৃষ্ণায় ভেজা মাটি চাটছে। লোকটি মনে-মনে ভাবলো, তৃষ্ণায় একটু আগে আমার যেমন অবস্থা হয়েছিলো, কুকুরটারও তো সেই দশা। লোকটি আবার কূপে নেমে পড়লো। মোজা ভরে পানি তুললো কুকুরটির জন্য। তারপর ফিরে এসে পানিভর্তি মোজাটি কুকুরের মুখের সামনে ধরলো। কুকুরটি পানি খেয়ে খেয়ে পিপাসা মেটালো। আল্লাহ তাআলা এই লোকটিকে ধন্যবাদ জানালেন এবং লোকটিকে ক্ষমা করে দিলেন।

রাসূলের শোনানো এসব ঘটনা শুধু কাহিনিমাত্র নয়; আগের যুগের কোথাও না কোথাও এগুলো বাস্তবে ঘটেছিলো। তিনি সেগুলোর বর্ণনা করতেন মাত্র। তিনি শিক্ষার জন্যও কোনো গালভরা কপোলকল্পনার জন্ম দিতেন না। প্রাণীদের হক আদায় করার ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহকে ভয় করার নির্দেশ দিয়েছেন। একবার তিনি ক্ষুধায় পেট পিঠের সাথে মিশে যাওয়া এক উটকে দেখে বেদনাহত হলেন; বললেন, ‘এই চতুষ্পদ প্রাণীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। এদের উপর ইচ্ছামাফিক আরোহী হোয়ো না। এদের ঠিকটাক খাবারের জোগান দিয়ো।’

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রাণীকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে তির ছুড়তে নিষেধ করেছেন। আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বরাত টেনে বলেন, নবীজি বলেছেন, ‘যে বস্তুতে প্রাণ আছে, তাকে তোমরা লক্ষ্যবস্তু বানিয়ো না।’

সাঈদ ইবনে যুবায়ের একজন সাহাবী। তিনি একদা বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমরের সাথে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ইবনে ওমরের সাথে আমি ছিলাম। একদল তরুণের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম, একটি মুরগি বেঁধে ওর দিকে তারা তির ছুড়ছে। ইবনে ওমর রা.-কে দেখে তরুণেরা এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে লাগলো। ইবনে ওমর রা. বললেন, এই কাজ কে করেছে? যে এই ধরনের কাজ করে, আল্লাহর রাসূল তাকে অভিশাপ দিয়েছেন।

সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বলে অপরকে নিকৃষ্ট জ্ঞান করার শিক্ষা রাসূল মানবসমাজকে দেননি। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তার কাজে ফুটে ওঠে বলে তিনি বুঝিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি সৃষ্টির জন্য এহসানকে আবশ্যক করে দিয়েছেন।’

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন এমনই সর্বব্যাপ্ত মমতার আশ্চর্য প্রতিরূপ…

তথ্যসূত্র : সহীহ মুসলিম, সহীহ বুখারী