পুত্র ও নাতির প্রতি মমতা

মাঝেমধ্যে নবীজি কেমন চঞ্চল হয়ে ওঠেন। যেন কার জন্য তাঁর মন কেমন করছে। সবসময়ই আর-সবার মতো তাঁর মনের গতিবিধি বোঝা যায় না। কে জানে, কোন কারণে মন তাঁর অমন আনচান। নবীজির পরিচয় কুরআন যথার্থভাবে তুলে ধরেছে,—তাঁরই জবানিতে :—“আমি তোমাদের মতোই মানুষ; কিন্তু আমার নিকট ওহি আসে…”। এই আয়াতেই তাঁর জীবনের রূপটি ফিরে-ফিরে আসে। তিনি যেন আমাদের মতোই,—কিন্তু এই বলেই কথা শেষ হয়ে যায়, কথা থেকে যায়; আর এই থেকে-যাওয়া কথা জুড়েই তিনি থাকেন। আপন জীবনের শব্দের মৌ-মৌ নিয়ে ঢুকে পড়েন আমাদের জীবনে।

কিন্তু নবীজি হঠাৎ কোথায় চলছেন?—প্রশ্নটি সাহাবী আবু হুরায়রার মনে। তাকেও তো কিছু বললেন না নবীজি। হঠাৎ কী হলো? এই ভর রোদে তিনি চলছেন কোথায়? আবু হুরায়রা এইসব প্রশ্ন ভাবতে-ভাবতেই নবীজির পিছু নিলেন। নবীজি একমনে হাঁটছেন। কোথাও থামছেন না। প্রখর রোদে দরবিগলিত হয়ে ঘামছেন। দেখতে-দেখতে বনু কায়নুকার বাজারে এসে নবীজি থামলেন। নিলেন কন্যা ফাতেমার বাড়ির পথ…

ফাতেমা রা. বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। খাওয়াচ্ছিলেন বা কাপড় পরাচ্ছিলেন। তিনি ঘরের আঙিনায় ঢুকেই বললেন, ‘বাচ্চারা কোথায়? আছে কি?’ একটু পরে তাঁর টের পেয়ে ছোট্ট হাসান দৌড়ে এলেন। নবীজি তাঁকে চুমু খেলেন। হাসানকে আদর দিতে-দিতে বললেন, ‘হে আল্লাহ, ওঁকে তুমি ভালোবেসো; ওঁকে যারা ভালোবাসবে, তাদেরও ভালোবেসো।’
আবু হুরায়রা নবীজির এমন হঠাৎ অস্থিরতার কারণ বুঝতে পারলেন; এবং তিনি ভালোভাবে নিরিখ করলেন, হাসানকে আদর করা ছাড়া আর অন্য কোনো কাজ তাঁর এই ভরদুপুরে ছিলো না। শুধু হাসানকে দেখার জন্য তিনি এমন অস্থির হয়ে পড়ছিলেন। হয়তো ফেরার পথে, একরাশ বিস্ময় আর বুকে এক আকাশ কী-যেন বোধের ঘনঘটা, তাই নিয়ে তিনি দেখছিলেন নবীজিকে; আর ভাবছিলেন, এই খুব সাধারণ মানুষটি, যাঁর কিনা বুকের তলটা উথালপাথাল হয়ে যায় ভরদুপুরে নাতির জন্যে,—এই সাধারণ মানুষটিই কিনা পয়গম্বর, তাঁর কাছে আসে ওহি, জিবরীল নেমে আসেন তাঁর জন্যে; তখন যে কী অলৌকিক ও অসাধারণ বিষয়ের অবতারণা হয়, তাও তিনি জানেন; সাধারণে আর অসাধারণে মিলানো এই মানুষটাই তাঁর নবীজি, শিক্ষক, আল্লাহর প্রেরিত রাসূল—এসব ভাবতে-ভাবতেই নবীজিকে খুব কাছের কেউ মনে হতে থাকি আবু হুরায়রার? সত্যিই তো তিনি সাহাবীদের খুব কাছের কেউই ছিলেন।

এরপর এরকম ঘটনা তাঁর জীবনে আরও অনেক দেখেছেন আবু হুরায়রা ও অন্যান্য সাহাবীরা। এসব দেখে জীবনের সাথে বোঝাপড়াগুলো তাঁরা শিখেছিলেন। জেনেছিলেন, ইসলাম কোনো বনের দিকে জীবন ফিরি সাধনা করার নাম নয়, ইসলাম মূলত জীবন; জীবনের যা কিছু প্রয়োজন ও অপ্রয়োজন, তার সাথেই ইসলামের চলা। জীবনের এমন কোনো ঘাট নেই, নেই এমন কোনো পথ, হোক তা জাগতিক বা অপার্থিব ব্যাপার, যেখানে মানুষ থেমে গেছে, অথচ ইসলাম বলে দেয়নি কোনো সমাধান; জীবনের এমন কোনো ঘাট নেই, নেই এমন কোনো পথ। নবীজির জীবনের সাথে চলতে-চলতে এই বাস্তবতা তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন।

আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশো বছর পেছনে গিয়ে কি আমরা তিন মাইল দূরত্বের কী ঝক্কি, কত-কত সমস্যা, আবার মরুর পথ, সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারবো? সেই অনুপলব্ধ সময়ক্রম ঘেঁটেই আমরা দেখতে পাবো, একজন মানুষ, যাঁর কাঁধে কিনা নবুওতের পাহাড়সম দায়িত্বের ভার, একটি রাজ্যের ভালো-মন্দ শাসনের সকল বিষয়-আশয়, সেই মানুষটিই মদীনা থেকে তিন মাইল দূরে আওয়ালী অঞ্চলে যাচ্ছেন; বিশ্লেষণী চোখে দেখতে গেলে, যাচ্ছেন না মহাকালের কোনো অংশ হতে, যাচ্ছেন তাঁর পুত্র ইবরাহিমকে ছুঁয়ে দেখতে, চুমু খেতে, ওঁর নরম তুলতুলে শরীরের ঘ্রাণ নিতে; তবু হয়ে যাচ্ছেন মহাকালের অংশ। তার বিভূতিময় এই জীবনাচারই আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে শেখায়, শেখায় অর্থ-বিত্ত-কাজ-দায়িত্ব এসবই কেবল জীবন নয়, জীবনের এক মোড়ে জুলজুল জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অপত্যস্নেহতা, নাতির প্রতি ভালোবাসা, সংসারের প্রতি গভীর অকৃত্রিম স্বাভাবিক সহজাত এক টান; যাকে কখনো আলগোছে সরিয়ে রাখা যায় জীবনের প্রয়োজনে, কিন্তু ওই আলগোছে সরানোটা কাজের নিমিত্তে মাত্র; এরপর ওখানেই জীবন…

ঘটনাসূত্র :সহীহ মুসলিম, যাদুল মাআদ।