সংসারকর্মের বাইরে নারীর মতামত ও অংশগ্রহণের ব্যাপারে নবীজি

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের দিকে না-তাকালে একজন মানুষের জন্য বোঝা সম্ভব নয় যে, জীবনের প্রতিটি বিষয়ের জন্যই তাঁর জীবনে আমাদের জন্য কত না উত্তম আদর্শ ও জীবন সুখে ভরিয়ে দেওয়ার মতো শিক্ষা রয়ে গেছে। সংসার ছাড়া নারীদের অন্য কোথাও কোনো অবস্থান থাকতে পারে কি না, সে ব্যাপারে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে রয়েছে হেদায়েত।

সংসারের কাজ ছাড়াও সর্বসাধারণের কাজে উম্মাহাতুল মুমিনীনদের অংশগ্রহণ এবং নবীজির কাজবাজেও তাঁদের মতামতের গুরুত্ব নবীজির সংসার-জীবনে দেখা গেছে। একবার নবীজির স্ত্রী উম্মে সালামা রা.-এর চুল আঁচড়ে দিচ্ছিলেন তাঁর দাসী। নবীজির স্ত্রীদের ঘর মসজিদে নববী সংলগ্নই ছিলো। নবীজি মসজিদে সাহাবীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলছিলেন। উম্মে সালামা রা. বলেন, ‘নবীজি “হে মানুষসকল…” বলেছেন, এমন শুনলাম আমি। শুনে দাসীকে বললাম, সরো, আমাকে যেতে হবে। দাসী বললো, তিনি তো পুরুষদের ডেকেছেন, আপনাকে ডাকেননি। আমি বললাম, তিনি “মানুষ” বলে সম্বোধন করেছেন, আমিও মানুষ।’ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীসত্তার ব্যাপারে তাঁদের ভেতর এত উন্নত স্বচ্ছ ও শানিত রুচি ও চেতনা তৈরি করে দিয়েছিলেন যে, তাঁরা নিজেদের ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন না। অত্যন্ত মর্যাদাকর ব্যক্তিত্ব নিয়ে তাঁরা স্বাধিকার অনুযায়ী নিজেদের অবস্থান ও গুরুত্ব বুঝে নিতে জানতেন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের সে শিক্ষাই দিয়েছিলেন।

সংসারকর্ম ছাড়াও নবীজির নবুওত-জীবনের কণ্টকতায় ঘেরা মক্কী জীবনে নবীজির বাইরের কাজেও সার্বক্ষণিক সহযোগিতা দিয়েছেন হযরত খাদিজা রা.। ব্যবসার কাজসহ নবুওতের সেই প্রথম দিনগুলোতে পরামর্শ দিয়ে, বন্ধুতা দিয়ে, সান্ত্বনা ও সাহস দিয়ে তাঁকে সর্বদা সজীব রেখেছিলেন এই মহাত্মা মহিয়সী। রাসূলের সকল কাজের সর্বত্রই ছিলো তাঁর এমন গুরুত্ব ও মর্যাদাকর অবস্থান ও সহযোগ যে, তিনি যখন বিদায় নিলেন এই পৃথিবী থেকে, ছেড়ে দিলেন বন্ধুর হাত, তখন শোকে মুহ্যমান রাসূল সে বছরের নাম দেন ‘শোকের বছর’।

আনাস রা. উহুদের যুদ্ধে নারীদের অংশগ্রহণের ব্যাপারে স্বচক্ষে দেখা ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি আয়েশা রা. এবং উম্মে সুলাইমানকে পায়ের কাপড় গোটানো অবস্থায় দেখলাম। আমি তাঁদের পায়ের অলঙ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। তাঁদের পিঠে পানির মশক ছিলো। পুরো যুদ্ধের ময়দানে তাঁরা সাহাবীদেরকে পানি পান করাচ্ছিলেন।

হোদায়বিয়ার সন্ধির সময় এ বিষয়ক একটি ঘটনা ঘটে। সংসার ছাড়া অন্যান্য বিষয়েও, এমনকি নবুওতের মতো মহা গুরুভারেও নারীর মতামতে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কেমন গুরুত্ব ছিলো, তা এই ঘটনার পরম্পরায় চোখ বুলালে বুঝতে পারা যায়।

হজের ব্রত নিয়ে মদীনা থেকে আসা সাহাবীদের মক্কার কাফেরদের কূটচালে সে বছরের জন্য হজ না-করেই মদীনা ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কাফেররা এই কূটচাল ও পাঁয়তারা সফল করার জন্য যেসব শর্ত দিয়েছিলো, তা আপাতদৃষ্টিতে অত্যন্ত বৈষম্যপূর্ণ ও অপমানজনক ছিলো। সাহাবীদের এ বৈষম্য ও অপমান মেনে নিতে মন মানছিলো না। তাঁরা যুদ্ধ করতে পর্যন্ত তৈরি ছিলেন। কিন্তু আল্লাহর রাসূলের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ ছিলো অন্যরকম। এই বৈষম্যকে আল্লাহ সুস্পষ্ট বিজয় বলে অভিহিত করেছিলেন। আল্লাহর সিদ্ধান্তের সামনে আল্লাহর রাসূল যখন সেসব বৈষম্য ও অপমানপূর্ণ শর্ত মেনে নিয়ে সাহাবাদেরকে মাথা মুণ্ডিয়ে এহরাম খোলার নির্দেশ দিলেন, অপমান ও দুঃখে ভারাক্রান্ত সাহাবারা বিমূঢ় হয়ে বসেছিলেন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের মনের অবস্থা বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু কী করবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না। কিছু ভেবে না-পেয়ে তিনি নিজের তাঁবুতে গেলেন। সেখানে ছিলেন তাঁর স্ত্রী উম্মে সালামা। রাসূলকে চিন্তিত দেখে উম্মে সালামা রা. কারণ জানতে চাইলেন। সব বিশদ করে বললে উম্মে সালামা রা. অতি সুন্দর একটি পরামর্শ দিলেন, যা রাসূলের খুব মনে ধরলো। তিনি বললেন, আপনি কাউকে কিছু না-বলে সাহাবীদের মধ্যে গিয়ে আপনার মাথার চুল মুণ্ডিয়ে ফেলুন। সাহাবীদের সেদিনকার সেই অভিমান-গুমোট অবস্থা উম্মে সালামা রা.-এর বুদ্ধিমত্তাতেই লাঘব হয়েছিলো।

রাসূলের জীবনের এসব দিকে লক্ষ্য করে একজন মুসলিম ও মুসলিমাকে খুঁজে নিতে হবে নবী-জীবনের কোথায় কীভাবে রয়ে গেছে আমাদের জন্য উত্তম আদর্শের শিক্ষা।

ঘটনাসূত্র : সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম