সংসারে স্ত্রীর অবস্থানের ব্যাপারে নবীজি

আমাদের এই সমাজে নানা ধ্যান-ধারণার প্রভাবে নারী বা স্ত্রীদের নিয়ে অনেক বাজে কথার প্রচলন আছে। তাদের নিয়ে আছে নানা অরুচিকর মূর্খ ধারণা। বুঝে না বুঝে সমাজের অধিকাংশ মানুষ—কখনো চেতনে, আবার কখনো-বা অবচেতনে—এসব বাজে কথা ও অরুচিকর মূর্খ ধারণার শিকার। এমনকি ইসলামের নাম ভাঙিয়েও আছে অনেক চালিয়াতি কথার বেসাতি। কিন্তু মুসলিমরা যদি এ কথা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন যে, ইসলাম সকল মানুষের জন্য শান্তি ও মুক্তির ধর্ম, আবার সাথে-সাথে সমাজে প্রচলিত এমন কথায়ও যদি তারা কান দেন, যা কিনা একজন নারীর জন্য প্রকৃতপক্ষেই অপমানজনক, তবে কি তাদের পালিত বিশ্বাস ও কানে-তোলা কথার ভেতর সংঘর্ষ বাঁধে না? অবশ্যই বাঁধে। আর এ সমস্যা বা সংঘর্ষ থেকে যেন একজন মুসলিম ও মুসলিমা বেঁচে থাকতে পারেন, সেজন্য রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘প্রত্যেক নর-নারীর জন্য প্রয়োজন-পরিমাণ এলেম (শরীয়িতের বিধি-বিধান) শেখা ফরজ।’ কিন্তু আমরা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই কথা না-মানার কারণে ইসলামের নামে প্রচলিত বাতেলাগুলো ধরতে পারি না, আবার বিভ্রান্তিরও শিকার হই। এজন্য শরীয়তের জ্ঞান অর্জন করা একজন মুসলিম ও মুসলিমার জন্য অতি-অবশ্য-কর্তব্য; এবং যিনি এই শরীয়তের প্রণেতা—হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—তাঁর জীবনের দিকে গভীর অন্বেষা ও জিজ্ঞাসা নিয়ে আমাদের তাকানো উচিত।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাংসারিক ব্যাপারে স্ত্রীদের কথাবার্তা অতি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতেন। বরং তিনি বলেছেন, ‘নারীরা তাদের স্বামীর ঘর ও সন্তানের তত্ত্বাবধায়ক। এ ব্যাপারে তাদের জিজ্ঞাসা করা হবে।’ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হাদীসে নারী একটি পরিবারের কত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, তা বলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নারী তার ঘরের তত্ত্বাবধান করবে এবং এই ব্যাপারের যাবতীয় জিজ্ঞাসাও তাকেই করা হবে; অথচ আমাদের সমাজে সংসারের গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই, অগুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারেও নারীদের তত্ত্বাবধান করতে দেওয়া তো দূরের কথা, তাদের মতামত নিতেও কৃপণতা করা হয়। বড়ই লজ্জার কথা, আর নিজেদের এসব অনৈতিক আরোপের পক্ষে এরা ইসলামকে মিথ্যা দলিল বানিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং নিজেরাও বিভ্রান্তির শিকার হয়ে থাকে।

বিখ্যাত সাহাবী দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর রা. কসম করে বলেন, ‘আল্লাহর কসম, জাহেলি যুগে আমরা নারীদের কোনো বিষয়েই গণ্য করতাম না। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা তাদের ব্যাপারে আয়াত নাযিল করেন এবং তাদের জন্য যথাযথ বণ্টননীতি নির্ধারণ করেন।’ এ ব্যাপারে ওমর রা. একটি ঘটনাও বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘একদা আমি কোনো কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এ সময় আমার স্ত্রী সামনে এলো। বললো, কাজটি এভাবে করলে হতো না? আমি বললাম, কী ব্যাপার, তুমি এখানে? আমার কাজে নাক গলাচ্ছো? শুনে আমার স্ত্রী বললো, হে খাত্তাবের সন্তান, খুব আশ্চর্য লাগছে; তুমি কি চাও না, আমি তোমার কোনো কাজে মতামত দিই? অথচ তোমার মেয়ে নবীজির সাথে বিবাদ করেন; আর নবীজি সে কারণে অভিমান করেও থাকেন।’ ওমর রা. তক্ষুনি উঠে দাঁড়ালেন এবং চাদর গায়ে জড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লেন। তারপর তিনি নিজ মেয়ে উম্মুল মুমিনীন হাফসা রা.-এর বাড়িতে গেলেন। বাড়িতে গিয়ে মেয়েকে বলেন, ‘মেয়ে আমার, তুমি কি নবীজির সাথে বিবাদ করো আর তিনি তোমার উপর সারাদিন রাগ করে কাটান?’ হাফসা রা. বললেন, ‘হ্যাঁ, বাবা, আমরা তাঁর কথার উপরে কথা বলি।’

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনোই সে বিষয়ে নির্দেশ করতেন না, যা তিনি নিজে আমল না করেছেন। তিনি সংসারে নারীকে তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দিয়ে নিজের সংসারে তাঁর স্ত্রীদের হাতে তাঁদের স্ব-স্ব সংসারের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। সে বিষয়ে তাঁদের তিনি স্বাধীন করেছেন। হ্যাঁ, তাদের কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সংশোধনী বা ততোধিক উত্তম কোনো হেদায়েত থাকলে তা দিতেও তিনি দেরি করেননি। মোদ্দাকথা, সংসার স্ত্রীর হাতে ছেড়ে দিয়ে তিনি স্ত্রীর কল্যাণকামী বন্ধু হয়ে গেছেন।

একবার মুহাজির ও আনসারদের এক দল নবীজির অপেক্ষায় বসা ছিলেন। তাঁরা ছিলেন নবীজির সাক্ষাৎপ্রার্থী। নবীজি বাড়িতে ছিলেন। নবীজির সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য তাঁরা আগে হযরত আয়েশা রা.-এর অনুমতি নিলেন। তিনি অনুমতি দেওয়ার পরেই তাঁরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারলেন।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবেই প্রত্যেককে তার অধিকার, প্রাপ্য, মর্যাদা বলে-কয়ে-করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন।

ঘটনাসূত্র : সহীহ বুখারী, নাসায়ী