অল্পবয়সী নারী বিয়ে

মনযূরুল হক

বিস্ময়ের কথা হলো, অনেকেই অল্প বয়স সত্ত্বেও আয়েশার রা. সাথে নবীজির বিয়ে নিয়ে সমালোচনার ঝড় তোলেন। এমনকি মাঝেমধ্যে মনে হয়, কতিপয় ইসলামপন্থী মানুষও এ-সম্পর্কে বিব্রত। আবার অনেক ইসলামপন্থী এভাবে ‘অল্পবয়সে মেয়ে বিয়ে দেওয়া সুন্নাত’ও আখ্যা দিয়ে থাকেন। আমরা তা-ই প্রথমেই নবীজি কিভাবে তার কন্যা বিয়ে দিয়েছেন, সেই প্রসঙ্গে যাবো।

এ-ক্ষেত্রে ফাতিমা রা.-এর বিয়ে আমাদের সামনে উজ্জ্বল প্রমাণ। কারণ নবীজির অন্য আরও তিন মেয়ের বিয়ে হয়েছে মক্কায় থাকতেই; যখন ইসলামের বিধানও নাযিল হয় নি। যদিও কেউ তাদের ব্যাপারেও প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারে নি যে, নবীজি তাদেরকে সাবালক হওয়ার আগে, কিংবা প্রচলিত ধারায় কম বয়স বলতে যা বোঝায়, সেই বয়সে বিবাহ দিয়েছেন।

বুরাইদাহ রা. বলেন, ফাতিমা রা.-এর জন্য আবু বকর ও ওমর রা. বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। নবীজি বললেন— সে এখনো ছোট। এরপর আলী রা. প্রস্তাব পাঠালেন। নবীজি তার সাথে ফাতিমাকে বিবাহ দিয়ে দিলেন। [1.(নাসায়ি, হাদিস ৩২২১)]

এ হাদিস এবং এ-বিষয়ক অন্যান্য হাদিসের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, আলী রা.-এর প্রস্তাব ছিলো আবু বকর ও ওমর উভয়ের প্রস্তাবের পরপরই। সেখানে সময়ের ব্যবধান তেমন ছিল না। তাই নবীজি যে বলেছেন ‘সে এখনো ছোট’, তার মানে এই নয় যে, সে এখনো বিবাহের যোগ্য হয় নি। বরং সে ছোট ছিল তার বয়স এবং আবু বকর ও ওমর রা.-এর বয়সের ব্যবধানের বিবেচনায়। কিন্তু আলী রা. যখন সামনে এগিয়ে এলেন, দেখা গেলো, তার বয়স ফাতিমার তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেশি নয়, বরং উভয়ের বয়স কাছাকাছি। এবং এ-কারণে তার প্রস্তাবও ফাতিমার জন্য উপযুক্ত। সুতরাং এই সিদ্ধান্তের মধ্যে আরেকটি দিক-নির্দেশনা রয়েছে। তা হলো, কন্যা সন্তানের জন্য কল্যাণকর দিক কোনটি, সেদিকে লক্ষ রাখা এবং যথাসম্ভব তা বাস্তবায়ন করা প্রত্যেক পিতার জন্য অবশ্য কর্তব্য।

সুতরাং যারা অল্প বয়সী মেয়ে বিবাহ দেওয়ার ক্ষেত্রে নবীজির সাথে আয়েশার বিবাহকে দলিল বানায় এবং সমালোচনাও করে। তারা লক্ষ করুন বিয়ের সমময় ফাতিমা রা.-এর বয়স কত ছিল এবং তিনি কীভাবে তাকে বিয়ে দিয়েছেন। ফাতিমা রা.-এর জন্মসন সম্পর্কে ঐতিহাসিক একটি মত হলো—তিনি নবীজির নবুয়তের ৫ বছর পূর্বে জন্ম নিয়েছেন। এটাই বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়। কেননা, নবুয়তের পর মক্কায় নবীজি নামাজে সেজদায় গেলে কাফেররা একবার যখন তার মাথায় উটের নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে দেয়, তখন ফাতিমা রা. দৌড়ে এসেছিলেন এবং তিনি নবীজির মাথা থেকে জঞ্জাল সরিয়ে তাকে উঠে বসার সুযোগ করে দিয়েছেন বলে প্রমাণ আছে। তাতে মনে হয়, তার বয়স অন্তত তখন সাত ছিল।

আবার অন্য একটি মত হলো নবীজির ৪১ বছর বয়সে তার জন্ম হয়। [2.(আল-মাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যাহ, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৬৩)]  তবে দ্বিতীয় হিজরিতে নবীজি তাকে আলী রা.-এর কাছে বিয়ে দেন, এ বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই। [3.( ‘মিন মায়ীনিস সীরাত’, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ২২৫)]  সুতরাং যদি প্রথম মতানুসারে বিয়ের সময় ফাতিমা রা.-এর বয়স ছিল ২০ বছর। এটাই যুক্তিযুক্ত। যদি দ্বিতীয় মতও ধরা হয়, তাহলেও তার বয়স ১৫ এর কম হতেই পারে না। এবং সে-সময় আরব মেয়েদের ১৫ বছর বয়স বিয়ের জন্য অন্তত যৌক্তিক বয়স ছিল।

সুতরাং আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ফাতিমা রা.-কে বিয়ে দেওয়া নবীজির কাজ এবং আয়েশাকে রা. বিয়ে করাও তার কাজ। কিন্তু দেখা যায় যে, আমরা একটির কথা সবসময় উল্লেখ করে এবং অন্যটি পুরোপুরি ভুলে যাই, যেনো সেটা ঘটেই নি?

উপরন্তু আয়েশা রা.-এর বিবাহ-ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন ঘটনা প্রমাণ করে, এই বিবাহ ছিলো নবীজি সা.-এর একটি বিশেষ বিষয়। আর অন্যগুলি ছিলো তার সাধারণ আমল। যে-কাজ ‘বিশেষ’ সেটাকে ‘সাধারণ’ কাজের ওপরে প্রাধান্য দেওয়া যায় না।

আয়েশা বিনতে আবু বকর সিদ্দিক রা.-কে নবীজি যখন বিয়ে করেন তার বয়স তখন ছয় বছর এবং তার সাথে বাসর যাপন করেন যখন তার বয়স নয় বছর। [4.(বুখারি, হাদিস ৫১৩৩)]  আয়েশা রা. বিবাহের উপযুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও কেনো তাড়াহুড়া করা হলো— তার ব্যাখায় আয়েশা রা. নিজেই বলেন, নবীজি আমাকে বলেছেন— আমি স্বপ্নে দেখেছি, একদল ফেরেশতা তোমাকে এক টুকরা রেশমি কাপড়ে জড়িয়ে নিয়ে এসেছে। একজন বললো, এটা আপনার স্ত্রী। আমি ওপর থেকে কাপড় সরালাম, সেখানে দেখি তুমি। আমি বললাম, এটা যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়, তাহলে আমি বাস্তবায়ন করব। বুখারির বর্ণনায় আছে— আমি দু’বার তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি। মুসলিমের বর্ণনায় আছে— আমি তোমাকে তিন রাতে স্বপ্নে দেখেছি। [5.(বুখারি, হাদিস ৩৮৯৫, মুসলিম, হাদিস ২৪৩৮)]

একই স্বপ্ন বারবার দেখা—এবং অবিদিত নয় যে, নবীদের স্বপ্নও এক ধরনের অহী—যা স্পষ্ট করে দেয় দ্রুত আকদ করার কথা। তাই এই বিবাহ করাটা ছিলো আল্লাহ তাআলার একটি আদেশ।

আয়েশা রা. বলেন— আমার সতীনরা একবার আমার বিরুদ্ধে সমবেত হয়ে নবীজির সামনে অভিযোগ করলে নবীজি বিমুখ হলেন। তৃতীয়বার যখন একই ব্যাপার হলে নবীজি বললেন—আয়েশার বিষয়ে আমাকে কষ্ট দিয়ো না। আল্লাহর কসম, তোমাদের মধ্যে আয়েশার ছাড়া অন্য কারও সাথে একবিছানায় থাকাকালে অহী নাযিল হয় নি। [6.(বুখারি, হাদিস ৩৭৭৫)]

এই হাদিস প্রমাণ করে, আল্লাহ তায়ালাই আয়েশা রা.-কে বিশেষভাবে এই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করেছেন। এটাও বোঝা যায় যে, এটা যে আল্লাহর পক্ষ থেকেই একটি বিশেষ নির্দেশ এ-বিষয়ে নবীজি সচেতন ছিলেন। যদিও তিনি স্ত্রীদের মধ্যে সমতা বিধান করেই চলতেন।

এই বিবাহের জন্যে কেনো অহীর মাধ্যমে আদেশ দেওয়া হলো এবং তার ঘরেই কেবল অহী নাজিলের বিশেষত্ব কী, সে-রহস্য নবীজির ওফাতের পর বোঝা যায়, যখন তিনি ইলমি বৈশিষ্ট্যে অতুলনীয়রূপে আবির্ভূত হন। তিনি ছিলেন উম্মতের মধ্যে সবচে’ বড় ফকীহ নারী এবং নারী-সাধারণের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী। বড় বড় সাহাবি তার বক্তব্যের দিকে ‘রুজু’ হতেন এবং তার ফতোয়া গ্রহণ করতেন। [7.(যাদুল মাআদ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১০৬)]

আয়েশা রা. ছিলেন অত্যন্ত ধীমতি নারী। তার কক্ষ মসজিদে নববী সংলগ্ন হওয়ায় তিনি সহজেই সর্বদা নবীজির বক্তব্য, হাদিস ও বিধিবিধান শোনার কাজে লেগে থাকতে পারতেন। কোনো বিষয় ছুটে গেলে নবীজিকে প্রশ্ন করে জেনে নিতেন। এমননিভাবে তিনি কুরআনের আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে এবং হাদিস বর্ণনার প্রেক্ষিত সম্পর্কে অবগত হতেন। এটাই তাকে এমন ফিকহী যোগ্যতা অর্জনের পথ সহজ করে দেয়, যার দৃষ্টান্ত বিরল। তা ছাড়া সাওদা রা.-কে বাদ দিলে তিনিই সবচে’ বেশি নবীজির নৈকট্য লাভ করেছেন। কারণ অন্য সকল স্ত্রীকে নবীজি বিবাহ করেছেন তার পরে দীর্ঘ সময় বিরতি দিয়ে দিয়ে।

তার বর্ণিত হাদিসের সংখ্যার দিকে একনজর তাকালেও তার অবস্থান ও যোগ্যতা পরিষ্কার হয়ে যাবে। তার বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা দুই হাজার দুইশ’ দশটি। তার পরেই আছেন উম্মে সালামা রা.; যার বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা তিনশত আটাত্তর। এরপর মাইমুনা রা. বর্ণনা করেছেন ছিয়াত্তরটি হাদিস। উম্মে হাবীবা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে পয়ষট্টিটি। হাফসা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে ষাটটি। জুইাইরিয়া ও সাওদা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে পাঁচটি করে। যয়নব বিনতে জাহাশ থেকে নয়টি এবং সাফিয়া রা. থেকে দশটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। [8.(আস-সীরাতুন নাবাবিয়্যাতুস সাহীহিয়্যা, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৬৪৯)]  সুতরাং যদি নবীজির অন্য স্ত্রীদের বর্ণিত সকল হাদিসকেও আমরা জমা করি, তবু তা আয়েশা রা.-এর বর্ণিত হাদিসের এক-তৃতীয়াংশের সমান হবে না। উপরন্তু নারী ও অন্যান্য বিষয়ে তার প্রদত্ত বিভিন্ন ফতোয়া তো রয়েছেই।

প্রায় অর্ধ-শতাব্দি পর্যন্ত তিনি ইলম ও ফতোয়ায় সাহাবীদের অনন্য ভরসাস্থল হিসেবে বহাল ছিলেন। এমন কোনো জটিল সমস্যা পাওয়া যায় নি, তার জ্ঞানে যার সমাধান ছিল না। আবু মুসা আশয়ারি রা. বলেন— আমরা রাসুলের সাহাবীগণ যখনই হাদিস সর্ম্পকিত কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়ে আয়েশা রা.-এর কাছে জিজ্ঞেস করতাম, তার কাছে অবশ্যই সমাধান পেতাম। [9.(তিরমিজি, হাদিস ৩৮৮৩)]  মাসরুক ইবনে আজদা বলেন— অনেক প্রবীণ সাহাবীদেরও দেখেছি তাকে ‘ফারায়েয’ বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে। [10.(মাজমাউয যাওয়ায়েদ, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ২৪২)]  প্রশ্নের জবাব দিতে তিনি যতটা পারঙ্গম ছিলেন, অন্য কাউকে তেমন দেখা যায় নি। এর একমাত্র কারণ নবীজির দীর্ঘ সন্নিধ্য।

সুতরাং সকল পিতার জন্যে নবীজির সুন্নাত হলো তাদের কন্যার বিষয়-আশয়কে গুরুত্ব দেওয়া এবং পাথির্ব ও পরকালীন উভয় বিবেচনায় যা তাদের জন্যে কল্যাণকর সেদিকে লক্ষ রাখা।