আবদুস সাত্তার আইনী
“আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুদ্ধগুলোর বিবরণ শিক্ষা দিতাম, যেভাবে কুরআনের সুরা শিক্ষা দিতাম।”—আলী ইবনুল হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমা। [1.আস-সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ, ইবনে কাসীর, ২য় খ-, পৃষ্ঠা ৩৫২।]
সীরাত বলতে বোঝায় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবনে ও যুগে সংঘটিত সমস্ত ঘটনার বিবরণ ও ইতিহাস। তিনি যা বলেছেন, যা করেছেন এবং যা-কিছুর অনুমোদন দিয়েছেন বা নির্দেশ দিয়েছেন তার সবকিছু সীরাতের অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবনচরিত, তাঁর চারিত্রিক গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্যসমূহ, তাঁর বংশধারা, তাঁর নবুওতের দলিলসমূহ এবং এগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলি, তাঁর যুদ্ধ ও জিহাদ সীরাতের মৌলিক বিষয়বস্তু। এটি কোনো সাধারণ মানুষের জীবনচরিত নয়; বরং সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী, পৃথিবীর ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মহামানব, মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ নেতার জীবনেতিহাস। একজন মুসলমানের জন্য সীরাত হলো সবচেয়ে বড় ও শ্রেষ্ঠ জ্ঞানভাণ্ডার।
শুধু জ্ঞান অর্জন নয়; বরং মুসলমান হিসেবে নিজের আকীদা ও বিশ্বাস এবং চিন্তা ও চেতনাকে একটি মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করার জন্য সীরাত পাঠ অপরিহার্য। মুসলমানদের অন্তরে ঈমান ও বিশ্বাসকে দৃঢ় করার জন্য সীরাত পাঠের আবশ্যকতা রয়েছে। কারণ, শয়তান সবসময় মুমিন বান্দার ঈমান হরণ করার চিন্তায় থাকে; অনেক সময় পারিপার্শ্বিক অবস্থাবলিও ঈমান বিনষ্ট করার কারণ হয়ে থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবনচরিত আলোকবর্তিকারূপে সামনে থাকলে আমাদের ঈমান ও বিশ্বাস পারিপার্শ্বিক আঘাত ও শয়তানের প্রবঞ্চনা থেকে মুক্ত থাকে। খাব্বাব ইবনুল আরাত রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একবার আমরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে অভিযোগ করলাম। তখন তিনি একটি চাদর মাথার নিচে রেখে কা‘বা ঘরের ছায়ায় বিশ্বাম নিচ্ছিলেন। যেহেতু মুশরিকদের পক্ষ থেকে আমাদের ওপর কঠিন নির্যাতন চলছিলো, তাই আমরা বললাম, আপনি আল্লাহর কাছে কেনো দোয়া করেন না? এই কথা শুনে তিনি সোজা হয়ে বসলেন। এই সময় তাঁর চেহারা মুবারক লাল হয়ে গেলো। তিনি বললেন, “(তোমাদের ওপর এমন আর কি নির্যাতন চলেছে?) তোমাদের পূর্ববর্তী যুগে যারা ঈমানদার ছিলো, এক আল্লাহর ইবাদত করতো, তাদের কারো জন্য মাটিতে গর্ত খোঁড়া হয়েছে, তারপর তাকে সেই গর্তে রেখে তার মাথার ওপর করাত চালিয়ে তাকে দ্বিখ-িত করা হয়েছে। তবুও ওই নির্যাতন তাকে তার দ্বীন ও ঈমান হতে ফেরাতে পারে নি। আবার কারো কারো শরীরের হাড় পর্যন্ত যাবতীয় গোশত ও শিরা লোহার চিরুনি দ্বারা আঁচড়াইয়া ফেলা হয়, তবুও সেই নির্যাতন তাকে তার দ্বীন থেকে ফেরাতে পারে নি।” [2.সহীহুল বুখারী, অধ্যায় : আল-মানাকিব, পরিচ্ছেদ : আলামাতুন নুবুওয়াতি ফিল ইসলাম]
সীরাতুন্নবীর পাঠ আল্লাহ তাআলার কিতাব কুরআন বোঝার জন্য সহায়ক। কুরআন বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছে। জিজ্ঞাসার জবাবে, সন্দেহ দূরীকরণে, নবীজীবনের কোনো ঘটনার ব্যাখ্যায় কুরআনের আয়াতগুলো ধারাবাহিকভাবে নাযিল হয়েছে। কুরআনে যেমন বদর যুদ্ধ, অহুদ ও খন্দকের যুদ্ধ, তাবুকের যুদ্ধ, হুদায়বিয়ার সন্ধি ইত্যাদি প্রসঙ্গে আলোচনা এসেছে, তেমনি হিজরতের ঘটনা, ইফকের ঘটনা, ইহুদিদের বিভিন্ন জিজ্ঞাসার জবাব, সাহাবীগণের বিভিন্ন প্রেক্ষিতে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব আলোচিত হয়েছে। সুতরাং কুরআনের এসব বিষয় বোঝার জন্য সীরাতের পাঠ অপরিহার্য। নবীজীবনের ধারাবাহিক ঘটনাবলির ওপর স্বচ্ছ ও স্পষ্ট ধারণা না থাকলে কুরআনকে যথার্থভাবে বোঝা যাবে না। কুরআনের ১১৪ টি সুরা ও তাদের আয়াতসমূহ নাযিল হওয়ার কার্যকারণ রয়েছে; আর এ সকল কার্যকারণ নিহিত রয়েছে রাসূলুল্লাহ সা.-এর জীবন ও সময়কালের ঘটনাবলিতে। কুরআন বোঝার পূর্বশর্ত হলো সীরাতের অধ্যয়ন ও তা আত্মস্থ করা।
হাদীস বোঝার জন্যও সীরাতের পাঠ জরুরি। হাদীসের গ্রন্থাবলিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নবীজীবনের ঘটনাবলি খণ্ডিত বা সংক্ষিপ আকারে উল্লেখ রয়েছে। কয়েকটি হাদীস একত্র করে একটি ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায়। যাঁরা হাদীস বর্ণনা করেছেন তাঁরা হয়তো একটি ঘটনার প্রতি শুধু ইঙ্গিত করেছেন এবং সংশ্লিষ্ট বিধান বর্ণনা করেছেন; কিন্তু পূর্ণ ঘটনার বিবরণ দেন নি। এ-সকল ক্ষেত্রে সীরাতের ওপর দখল থাকা অত্যন্ত জরুরি। নবীজীবনের অনুপুঙ্খ ঘটনারাশিকে আত্মস্থ করতে পারলে হাদীস ও সুন্নাহ বোঝা অত্যন্ত সহজ। রাসূলুল্লাহ সা.-এর জীবনচরিতকে ও সুন্নাহকে আলাদাভাবে বোঝার কোনো পথ নেই; তাঁর জীবনের নির্যাস ও সারবত্তাই হাদীসশাস্ত্রে বিবৃত হয়েছে। কোনো কোনো হাদীস আছে যা পাঠ করে বোঝা দুঃসাধ্য, কারণ সংশিষ্ট ঘটনাটি জানা নেই। যে-সকল হাদীস কোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে বর্ণিত হয়েছে, সংশিষ্ট ঘটনার বিবরণ জানা না থাকলে ওই হাদীসটি কিছুতেই বোঝা যাবে না। এ-কারণেই নবীজীবনের ও তাঁর কালের ইতিহাস পাঠ অনিবার্য।
আরেকটি কারণে সীরাত পাঠের বিকল্প নেই; তা হলো ইসলামি আকীদা ও বিশ্বাসকে উপলব্ধি করা ও ধারণ করা। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বিশ্বাসকে কর্মে রূপ দিয়েছেন; তিনি যা বিশ্বাস করতেন, তা-ই বললেন এবং তা-ই অনুষ্ঠান করতেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আমলি যিন্দেগী, তাঁর তাকওয়া ও পরহেযগারিতা, আল্লাহ তাআলার প্রতি তাঁর আস্থা ও আনুগত্য, ইখলাস ও সত্যনিষ্ঠা এ-সকল বিয়ষ উপলব্ধি ও ধারণ করার জন্য সীরাত পাঠের বিকল্প নেই। সত্যের পথে নবীজীর দৃঢ়তা, কষ্ট ও বিপর্যয়ে তাঁর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা, শত্রুদের উৎপীড়ন ও নির্যাতনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্থির বিশ্বাসে অটলতা তাঁর উম্মতের জন্য শিক্ষণীয় ও অনকরণীয়। আকীদা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে কোনটি গ্রহণযোগ্য আর কোনটি বর্জনযোগ্য; আমলের ক্ষেত্রে কোনটি গ্রহণযোগ্য বা গ্রহণঅযোগ্য; ইসলামি বিশ্বাসকে ধারণ করে জীবনচলার পথে কোনটি অনুকরণযোগ্য ও কোনটি বর্জনীয় তা জানার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবনচরিতের পাঠ অপরিহার্য।
নবীজীর মক্কী জীবন ছিলো ঈমানের পথে এক বিশাল অগ্নিপরীক্ষার নাম। তাওহীদ, একত্ববাদ, আল্লাহর মহত্ত্ব, বড়ত্ব ও পবিত্রতার বিষেয় অবিশ্বাসীদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত যাবতীয় প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা ও সন্দেহের জবাব পাওয়া যাবে সীরাতের মক্কী জীবন অংশে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও তাহলে আমার অনুসরণ করো।” [3.সুরা আলে ইমরান : আয়াত ৩১] এই আয়াতে আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসার জন্য মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণকে শর্ত করা হয়েছে। আর নবীজীকে তখনই যথার্থভাবে অনুসরণ করা যাবে যখন তাঁর জীবনসংগ্রাম, তাঁর যুদ্ধ ও জিহাদ, তাঁর আদেশ ও নিষেধ, তাঁর বিচার ও ফয়সালা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকবে।
তিনি যখন মক্কী জীবনে দুর্বল ছিলেন তখন মানুষের কীরূপ আচরণ করেছেন, মদীনার জীবনের যখন রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব তাঁর হাতে এলো তখন মানুষের প্রতি তাঁর কী ধরনের আচরণ ছিলো তা বোঝা ও অনুধাবন করা একজন সচেতন মুসলমানের জন্য জরুরি। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “তোমাদের মধ্যে যাঁরা আল্লাহ ও আখেরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।” [4.সুরা আযহাব : আয়াত ২১]
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন ইসলামি শরীয়তের প্রবর্তক। বলা হয়ে থাকে যে, সীরাতুন্নবী বা নবীজীর জীবনচরিতই হলো শরীয়ত-সংক্রান্ত জ্ঞানের আধার। তাঁর জীবেন শরয়ী হুকুম-আহকামের বাস্তবিক রূপ মূর্ত হয়ে উঠেছে এবং ইসলামের প্রতিটি বিধানের প্রায়োগিক ব্যাখ্যা রয়েছে। শরয়ী শিক্ষা-দীক্ষার মূল ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে তাঁর প্রবর্তকের জীবনচরিতের ওপর। সুতরাং শরয়ী শিক্ষা-দীক্ষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে হলে নবীজীর জীবনচরিত পাঠের বিকল্প নেই।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাম্পত্য জীবনযাপনে ছিলেন আদর্শ ব্যক্তিত্ব। স্ত্রীদের সঙ্গে সদাচার, তাদের অভিমান ও রাগ ভাঙানো, সাংসারিক কাজকর্ম করা, ভরণপোষণের ক্ষেত্রে সমতা বজায় রাখা—প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুকরণীয় শিক্ষা রেখে গেছেন। আমাদের দাম্পত্যজীবনকে সুন্দর ও সুখী করতে হলে নবীজীর শিক্ষা গ্রহণ করা ছাড়া উপায় নেই। এর জন্য সীরাতের পাঠ জরুরি।