ভালোবাসার এক অবাধ আকাশ নিয়ে ঘুরতেন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। হৃদয়ের নড়াচড়া এত নিবিড়ভাবে বুঝতেন, যে, মন তাঁর প্রতি মুগ্ধ হয়ে যায়। নবুওতের সুমহান দায়িত্ব পালনকারী এক সনিষ্ঠ নবী হয়েও তিনি ছিলেন একজন প্রেমময় স্বামী। তাঁর অনুপম জীবনে তিনি রেখে গেছেন স্বামীচরিত্রের অপূর্ব মাধুরী। তাঁর ছিলো একাধিক বিয়ে। নানান বিবেচনায় ও দরকারে এসব বিয়ের প্রয়োজন ছিলো। তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসূল। অন্যান্য আর-সব কাজের মতোই আল্লাহর হুকুমেই তিনি একাধিক বিয়ে করেছিলেন। একাধিক বিয়ে হলেও স্ত্রীদের প্রতি ছিলো তাঁর সুসম সদয় মমতাপূর্ণ আচরণ। একের অধিকতা তাঁর মনকে কখনো অনুদার করতে পারেনি; সমতার ব্যাপারে তিনি যে দৃষ্টান্ত তাঁর সংসার-জীবনে দেখিয়ে গেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তা অনুকরণীয় সংসারধর্ম।
সকল স্ত্রীগণই মনে-প্রাণে তাঁকে চাইতেন। দুনিয়ার আর-সব নারীর মতো তাঁদেরও ছিলো স্বামীর প্রতি অভাব-অভিযোগ, রাগ-অনুরাগ আর মান-অভিমানের পালা। নবী বলে কোনো রাশভারী রূপ নিয়ে তিনি প্রকাশ হতেন না স্ত্রীদের সামনে। প্রেমের এক অবিরল বিচ্ছুরণ নিয়ে তিনি মোহিত করতেন আপন স্ত্রীদেরকে। তাঁরও ছিলো স্ত্রীদের প্রতি রাগ-অনুরাগ ও মান-অভিমান। নবুওতের গুরুভার তাঁর সংসার-জীবনকে বিঘ্নিত করতে পারতো না। তিনি ছিলেন এমনই এক মোহময় সত্তা, স্ত্রীরা প্রহর গুণে তাঁর অপেক্ষায় থাকতেন। তাঁর ভালোবাসার ভাগ নিয়ে হতো মধুর-বিধুর ঝগড়া-বচসাও; কিন্তু এসব ঝগড়া-বচসার কিছুই তাঁদের একে-অপরকে শত্রু করে তুলতো না। যাঁকে নিয়ে তাঁদের এই মধুর-বিধুর মান-অভিমান, তাঁর ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকতো। আবার সময়ের স্রোতে এসব মান-অভিমান ধুয়েও যেতো। সকলেই অপেক্ষা করতেন–কখন আসবেন তাঁর প্রেমময় স্বামী…।
আয়েশা রা.বলতেন, ‘পৃথিবীর নিয়মে তোমাদের সূর্য ওঠে সকালবেলা, কিন্তু আমার ঘরে সূর্য ওঠে এশার পরে।’ রাসূলের ঘরে আসাকে তিনি ভোরের সূর্যের মতো তন্ময় আর আনন্দঘোর ব্যাপারের সাথে উপমা দিয়ে রাসূলের প্রতি তাঁর নিখাদ অকৃত্রিম ভালোবাসাকেই বুঝিয়েছিলেন, আর উপলব্ধি দিয়েছিলেন আমাদেরকে যে, কতটা প্রেমপ্রগাঢ় স্বামী ছিলেন রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
স্ত্রীদের প্রতি তাঁর সমতার আচরণ ছিলো অভূতপূর্ব। তিনি একেক দিন একেক স্ত্রীর ঘরে রাত কাটাতেন। কিন্তু প্রতিদিন একবার করে খোঁজ নিতেন সকল স্ত্রীরই। কখনো কোনো ব্যস্ততায় এর ব্যত্যয় ঘটলে ছিলো আরেক রীতির বাস্তবায়ন। সে রাতে যে স্ত্রীর ঘরে তাঁর রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা হতো, সেখানেই উম্মাহাতুল মুমিনীন একত্র হতেন। রাসূল তাঁদের সাথে সংসারী আলাপে মেতে উঠতেন। নবুওত ও রেসালাতের গুরুভারে তাঁকে আড়ষ্ট কেউ বলে কখনোই ভ্রমও হতো না তাঁর স্ত্রীদের। সকল বিষয়েই ছিলো তাঁর আশ্চর্য এক পরিমিতির সমবায়। গুরুভারি বিষয়কেও ন্যায্যতার পাল্লায় ফেলে তাতে তিনি নিয়ে আসতেন সমন্বয়তার আশ্চর্য নন্দন রূপ। এত সবের মাঝেও তিনি বুঝিয়ে দিতেন স্ত্রীদেরকে, তিনি তাঁদের কত করে বোঝেন।
একবারের ঘটনা। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে ডাকলেন। বললেন, ‘জানো আয়েশা, তুমি কখন আমার উপর রাগ করে থাকো, তা আমি বুঝতে পারি।’ আয়েশা তো অবাক। জিজ্ঞাসা, কৌতূহল আর আসলেই রাসূল কতটুকু খেয়াল করেন তাঁকে, এমন এক প্রশ্নমুখে তাকালেন তিনি রাসূলের দিকে; বললেন, ‘বলুন শুনি, কখন?’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘যখন তুমি আমার উপর খুশি থাকো, তখন বলো, হে মুহাম্মদের প্রতিপালক; আর রেগে থাকলে বলো, হে ইবরাহিমের প্রতিপালক।’ আয়েশা দেখলেন, রাসূল তো ঠিকই বলেছেন। শুনে মন তাঁর ভীষণ খুশি হয়ে উঠলো। বুঝি ভাবলেন, কী অকৃত্রিম প্রেমময় স্বামী তাঁর—নবুওতের এত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়েও তিনি কত খেয়াল রাখেন স্ত্রীর খুশি-অখুশির; পইপই করে জানেন, কখন স্ত্রী রেগে আছে, আর কখন স্ত্রী খুশি। খুবই খুশি লাগলো আয়েশা রা.-এর। তিনি বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন।’ এমন ভালোবাসার দেখভালের জবাবে একটি কথা বলতে কিছুতেই ভুললেন না বুদ্ধিমতী ও প্রেমময়ী রাসূলসঙ্গিনী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা। তিনি বললেন, ‘মুখেই আমি আপনাকে ত্যাগ করি, কিন্তু আমার অন্তরে আপনি সবসময়ই থাকেন।’
এমন অজস্র ভালোবাসার ঘটনায় পূর্ণ হয়ে আছে রাসূলের দাম্পত্য-জীবন, যেসব ঘটনার প্রতিটিই আলাদা করে বলে দেয়, তিনি ছিলেন এক প্রেমময়ী স্বামী…।
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
ঘটনাসূত্র : সহীহ মুসলিম।