ঘুম : নবীজির আদর্শ ও নির্দেশনা

ঘুম মানব জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। জীবনের একটা বড় অংশ আমরা ঘুমিয়ে কাটাই। ঘুমকে অর্থহীন মনে করার কিছু নেই। ঘুম ছাড়া আমরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবোনা। জীবনের প্রতিটা অধ্যায়ের মতো ঘুমের ক্ষেত্রেও নবীজির বিশেষ কিছু নির্দেশনা ও আদর্শ রয়েছে।

১) ঘুমের সময়

নবীজি রাতে দ্রুত ঘুমিয়ে যেতে বলেছেন। ‘ নবীজি  এশার আগে ঘুমিয়ে যাওয়াকে অপছন্দ করতেন এবং এশার পর দুনিয়াবি কথা বলাকেও অপছন্দ করতেন। ‘ [1.( বুখারি ৫৬৮। তিরমিজি ১৬৮ )] কেননা দ্রুত না ঘুমালে সময় মত ঘুম থেকে উঠতে কষ্ট হয়ে যায়। ফজরের নামাজ ছুটে যাবার আশংকা থাকে। দেরী করে ঘুমালে অনর্থক কথাবার্তায় সময় নষ্ট হয়। পরদিন কাজকর্মে দ্রুত অলসতা ও ক্লান্তি সৃষ্টি হয়। অবশ্য ধর্মীয় কাজের কারণে  দেরী করে ঘুমানোর অনুমতি আছে। তবে, এক্ষেত্রেও দেরী করে ঘুমানোর সমস্যাগুলো থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হবে।

 

২) ঘুমের আয়োজন

ঘুমানোর আগে দরজা বন্ধ করে শুতে হবে, পাত্রের মুখ বন্ধ করতে হবে বা ঢেকে রাখতে হবে, বাতি নিভিয়ে ফেলতে হবে। কেননা  ‘নবীজি বলেছেন, তোমরা ঘুমানোর আগে দরজা বন্ধ করে দাও, পাত্র ও পানির পট ঢেকে রাখো, বাতি নিভিয়ে দাও।'[2. ( তিরমিজি ১৮১২। মুসলিম ২০১২)] কেননা ঘুমন্ত অবস্থায় কেউ ঘরে ঢুকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে, পাত্রে ময়লা পড়তে পারে এবং বাতির আগুন থেকে ছড়িয়ে যেতে পারে গৃহময়। এভাবে অনেক বিপদ-আপদের আশংকা আছে।

৩) ঘুমের প্রস্তুতি

ওজুর সাথে ঘুমাতে হবে এবং হাতে তৈলাক্ততা থাকলে সেটা ধুয়ে ফেলতে হবে। ঘুমানোর আগে বিছানা ঝেড়ে নিতে হবে।    নবীজি বলেছেন, তুমি বিছানায় যাওয়ার ইচ্ছা করলে আগে ওজু করে নাও।[3. ( বুখারি ২৪৭। আবু দাউদ ৫০৪৬। )] নবীজি আরও বলেছেন, যদি ঘুমানোর সময় কারো হাতে তৈলাক্ততা থাকে, হাত না ধুয়ে নেয়, পরবর্তীতে তার হাত কোন কিছুতে আক্রান্ত হল, তখন সে যাতে শুধু নিজেকেই দোষ দেয়। [4.( ইবনে মাজাহ ২৬৮২ । আবু দাউদ  ৩৮৫২। )] ‘ তোমরা ঘুমানোর জন্য বিছানার কাছে আগে বিছানা ঝেড়ে নাও।[5. ( মুসলিম ২৭১৪। বুখারি ৬৩২০)] কেননা এতে পবিত্র অবস্থায় ঘুমানোর প্রতি উৎসাহ যোগানো হয়। যেহেতু দীর্ঘসময় ঘুমিয়ে থাকা হবে, পরিচ্ছন্নতার সুযোগ আসবেনা, তাই শেষবারের মতো পরিচ্ছন্ন হতে হবে। এতে পবিত্র অবস্থায় ঘুমের শুরু হবে।অসুস্থতা, অর্থহীনতা ও পাপ থেকে মুক্ত থাকার প্রতি গুরুত্ব আরোপ হবে।

 

৪) ঘুমের আগে চোখের সুস্থতা

ঘুমের আগ চোখে সুরমাও লাগানোও নবীজির নিয়মিত অভ্যাস ছিল।  ‘নবীজি ঘুমানোর আগে চোখে ইছমিদ সুরমা লাগাতেন।’ [6.( তিরমিজি ১৭৫৭ )]  কেন? নবীজি বিভিন্ন হাদিসে এর কারণও  ব্যাখ্যা করেছেন। সুরমা চোখকে পরিষ্কার রাখে, সুস্থ রাখে ও চোখের শক্তি বৃদ্ধি করে।চোখের পাপড়িকেও সুস্থ-সক্রিয় রাখে। সংখ্যা বৃদ্ধি করে। এভাবে নবীজি সুরমা ব্যবহারের গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন।

 

৫) ঘুমানোর আগের নিয়ত

তওবা করা, নিজের অন্তর থেকে হিংসা-বিদ্বেষ দূর করার চেষ্টা করা, তাহাজ্জুদের নিয়তে ঘুমানো, এগুলোর বিষয়েও বিভিন্ন হাদিসে নবীজি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। নবীজি বলেছেন, যে ব্যক্তি ঘুমানোর আগে ইসতেগফার করবে, তার অনেক ফজিলত বর্ণনা করেছেন। [7.( তিরমিজি  ৩৩৯৭ )] ‘নবীজি বলেছেন,যদি তুমি হিংসা-বিদ্বেষহীনভাবে সকাল-সন্ধ্যা কাটাতে পারো, তাহলে এটাই করো। এটা আমার সুন্নত।  [8.(তিরমিজি  ২৬৭৮ )]  যে ব্যক্তি তাহাজ্জুদ পড়ার নিয়ত রেখে ঘুমাতে গেলো, তবে প্রবল ঘুমের কারণে ভোরেই উঠলো, তো, তাকে তার নিয়তের ছওয়াব দেওয়া হবে। তার ঘুমটা আল্লাহর পক্ষ থেকে তার প্রতি সাদাকাহ হয়ে যাবে। [9.( নাসাঈ ১৭৮৮ )] বস্তুত ঘুম একটা ছোটখাটো মৃত্যুর মতোই। ঘুমের মাধ্যমে মানুষ তার মৃত্যুর বাস্তবতা বুঝতে পারে। তাই ঘুমের তওবা, ইসতেগফার করে নিবে এবং তাহাজ্জুদের নিয়ত রেখে ঘুমাবে। আল্লাহ তাকে এর ছওয়াব দিয়ে দিবেন।

 

৬) ঘুমানোর আগের আমল

ঘুমানোর আগে নবীজি যেসব আমল করতেন, সেগুলোর মধ্যে নির্বাচিত কিছু অংশ করে নিবে। নবীজি আবু হুরাইরা রাদিঃ কে আয়াতুল কুরসি পড়ার পরামর্শ দেন। [10.( বুখারি ২৩১১ )] সূরায়ে বাকারার শেষ দুই আয়াত পড়ে ঘুমানোর প্রতিও নবীজি আগ্রহ প্রদান করেছেন। [11.( বুখারি ৪০০৮)] । সূরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পড়ার প্রতিও আগ্রহ প্রদান করেছেন। নবীজি বলেন, বিছানায় যাবার ইচ্ছা করলে,কুল হুয়াল্লাহু, নাস ও ফালাক পড়ে হাতের তালুতে ফুঁ দিবে এবং তারপর হাত দিয়ে মুখ ও শরীরের যতদূর পর্যন্ত হাত পৌঁছে ততদূর পর্যন্ত মুছে দিবে। ( বুখারি ৫৭৪৮) । নবীজি সূরায়ে যূমার, মুলক, বনী ইসরাইল ও আলিফ লাম মীম সেজদাহ তেলাওয়াত করে ঘুমাতেন। [12.( তিরমিজি ২৪০৪ ) ( তিরমিজি ৩৪০৫)]। এভাবে ঘুমের ইসলামের মহান পয়গামের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ হয়। এর শব্দ, মর্ম ও মাকাসেদের সাথে সম্পর্ক হয়। আলফাজ ও তারান্নুম বা শব্দ ও সুরের সাথে সম্পর্ক হয়। একইভাবে পবিত্র কোরআন বান্দার জন্য অনেক বিপদ-আপদ থেকে রক্ষার মাধ্যমও বটে। এই অংশগুলো পড়ার মাধ্যমে বান্দা অনেক বিপদ-আপদ থেকেও বেঁচে থাকতে পারে।

 

৭) কীভাবে শুতে হবে?

ডান কাত হয়ে ঘুমানো, চেহারার নীচে ডান হাত রেখে তিন বার ‘আল্লাহুম্মা  কীনি আজাবাকা ইয়াওমা তাবআছু ইবাদাকা’ এই দোয়া পড়া, ঘুম আসার আগ পর্যন্ত তাসবীহ পড়তে থাকা, উল্টো হয়ে না ঘুমানো, চিত হয়ে ঘুমালে এক পায়ের উপর আরেক পা রেখে না ঘুমানো, এগুলোও নবীজি সুন্নত। [13. ( বুখারি ২৪৭ ) ( আবু দাউদ ৫০৪৫ ) ( আলে ইমরান ১৯১ ) ( তিরমিজি ২৭২৮ ) ( তিরমিজি ২৭৬৬)] উল্টো হয়ে ঘুমানো স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ভালো ও পূর্ণ ঘুমের জন্য শরীর ঠিকঠাক ভাবে রেখে ঘুমানো জরুরী। নয়তো শরীরে ব্যথার সৃষ্টি হতে পারে। ঘুম অপরিপূর্ণ থেকে যেতে  পারে। দ্রুত ঘুম না আসলে মনে অনেক রকম দুশ্চিন্তা আসতে থাকে। তাই এমন সময় মৃত্যুর কথা স্মরণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।আল্লাহর পবিত্রতা স্মরণ করে তাসবীহ পড়তে বলা হয়েছে।

 

৮) এভাবে ঘুমানো নিষেধ!

পাশাপাশি দুইজন পুরুষ বা মহিলা এক চাদরে বা কাপড়ের ভেতর ঢুকে না ঘুমানো, মাথার ওপর ছাদ নেই, এমন বাড়িতে না ঘুমানো, চলাচলের রাস্তায় না ঘুমানো, এগুলোও নবীজির ঘুম বিষয়ক নির্দেশনা। [14.( তিরমিজি ২৭৯৩ ) ( আবু দাউদ ৫০৪১) ( মাজমাউয যাওয়ায়েদ ১৩১৮৬)] কেননা সমলিঙ্গের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও এক কাপড়ের ভেতরে ঢুকে ঘুমালে নানা রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে। মাথার ছাদ না থাকলে আকাশ খোলা থাকায় নানা রকম দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। চলাচলের রাস্তায় ঘুমালে জনসাধারণের দুর্ভোগ সৃষ্টি হবে।

 

জীবনের অন্য সকল অংশের মত ঘুমের ক্ষেত্রেও নবীজি আমাদের জন্য উত্তম নমুনা। এভাবে ঘুমও হয়ে উঠতে পারে ইবাদত। নবীজির নির্দেশনা মানলে, আমরা যেমন দেখিয়েছি, যথাযথ ও পরিপূর্ণভাবে ঘুমানোর ব্যবস্থাপনাও হয়ে যায়। আল্লাহ আমাদেরকে নবীজি আদর্শ ও নির্দেশনা মেনে চলতে তওফীক দান করুন।