সাহাবীরা ছিলেন জাহেলি যুগের মানুষ। জীবন ছিলো অন্ধকার পঙ্কে ভরা। হঠাৎই জীবনে আলোর যে প্লাবন এসেছিলো, তা হৃদয়কে আলো-ঝিলমিল সকল ধ্রুবের জন্য, সত্যের জন্য উন্মুখর পাগল ও আগ্রহী করে তুললেও জীবনের খাঁজে লুকিয়ে-থাকা সকল কালিই কিন্তু একদিনেই মুছে যায়নি। দরবারে-নবুওতে দিন-রাতের আনাগোনা তাঁদের শিখিয়েছিলো জীবন কত উৎসবভরা এক বাগানের নাম। রাসূলের দরবার থেকে শিখে কোনো-কোনো দিন, কে জানে কোন সাহাবী, প্রথম হাসতে শিখেছিলো; প্রথম বুঝতে শিখেছিলো, প্রেয়সী দাসী নয়, জীবনের একমাত্র বন্ধু; মায়ের সাথে বলতে শিখেছিলো সুন্দর করে কথা; শিশুরা যে হাসে, সে হাসিতে ছড়িয়ে পড়ে জান্নাত, বুঝতে শিখেছিলো; আসলে, পুরো জীবনের দিকেই এক বিস্ময়করা চোখ নিয়ে তাঁরা তাকাতে শিখেছিলো।
তেমনই একটি ঘটনা। সাহাবীরা নবীজির সামনে বসে আছেন। হচ্ছে সাধারণ বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো আলাপ। আকরা নামের একজন সাহাবীও বসা। তিনি লক্ষ্য করছেন নবীজির সবকিছু। নবীজি কথা বলছেন বা বলছেন না, শুনছেন সাহাবীদের কথা—তিনি লক্ষ্য করছেন; কিন্তু কিছুই বলছেন না। এমন সময় হঠাৎ মজলিসে এলেন ছোট্ট হাসান। রাসূলের মমতা নিবদ্ধ হলো ছোট্ট নাতির প্রতি। মজলিসে ছেদ পড়লো। রাসূল হাসানকে জড়িয়ে ধরলেন। চুমু খেলেন হাসানকে। খুব তৃপ্ত আর আনন্দিত দেখা গেলো বুঝি নবীজিকে। আকরা কিন্তু দেখছেন সব—ছোট্ট হাসানের আসা, নবীজির তাঁর প্রতি মনোযোগী হওয়া, মজলিসে ছেদ, রাসূলের হাসানকে চুমু খাওয়া। তাঁর মনে কথা আকুলিবিকুলি করে উঠলো। তিনি তো করেন না এর কিছুই, অথচ রাসূল করছেন। এতক্ষণ চুপ-বসা আকরা কথা বলে উঠলেন। বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমার দশ সন্তান। আমি কখনো ওদের চুমু খাইনি।’ রাসূল আকরার দিকে একবার তাকালেন। কী ভাবলেন তিনি? এরকম কিছু কি—আহা, জাহেলি জীবন জীবন থেকে কত দূর নিয়ে তোমাদের ফেলেছে? ফুলের মতো মোলায়েম শিশুরাও বঞ্চিত হয়ে গেছে তোমাদের আদর থেকে? কী ভাবলেন আকরার দিকে তাকিয়ে তিনিই জানেন। একটু পরে বললেন এমন একটি কথা, যা এই আদর, এই মমতা, এই স্নেহকে অপরিহার্য করে তোলে; করে তোলে জীবনের একটি অংশও; তিনি বললেন, ‘যে মমতা দেখায় না, তার প্রতি মমতা দেখানো হয় না।’
সবচেয়ে মজার ব্যাপার ঘটতো গ্রাম্য কোনো ব্যক্তি নবীজির কাছে এলে। সাহাবীরাও এইসব গ্রাম্য মানুষদের আসার দিকে উন্মুখ হয়ে থাকতেন। কেননা, রাসূলের কাছে যে সাহাবীরা থাকতেন, তাঁরা রাসূলের সাথে থাকতে-থাকতে বুঝতেন, তিনি কে আর কত উঁচু তাঁর মর্যাদা। তাই কখনো প্রশ্ন মনে গোড়ায় আটকে থাকলেও অনেক বিবেচনায় তা করা হতো না; কিন্তু এই গ্রাম্য আলাভোলা সাধারণ মানুষগুলো এলে তাঁদের খুব আনন্দ হতো; এরা নানা সাধারণ আর গুরুত্বপূর্ণ-অগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করতো; রাসূল সেসবের জবাব দিতেন; এই প্রশ্ন-উত্তরের বাহানায় তাঁদের অনেক কিছু জানা হয়ে যেতো, কখনো মিলে যেতো তাঁদের অনেক প্রশ্নের জবাবও। বেদুইনদের আসার দিকে তাঁদের উন্মুখ হয়ে থাকার এ-ই ছিলো কারণ।
সেরকমই একবার এক বেদুইন এসে বললো, ‘আপনারা আপনাদের সন্তানদের চুমু খান, আমরা এটা কখনোই করি না।’ নবীজি বললেন, ‘আল্লাহ যদি তোমার অন্তর থেকে দয়ামায়া উঠিয়ে নেন, তো সেই ব্যাপারে আমাদের কী করার আছে।’ রাসূলের এই কথা এমন শিক্ষাই দিয়ে গেলো যে, সন্তান বা নাতি-নাতকুরকে চুমু দেওয়া মমতার একরকমের প্রকাশ। তা থেকে দূরে থাকা ভাব-গাম্ভীর্যতার কোনো আলামত না, বরং আল্লাহ যে ওই ব্যক্তির অন্তর থেকে মমতা সরিয়ে দিয়েছেন, তারই চিহ্ন এসব।
বাস্তব অর্থে, এইসব মমতা ও হৃদয়বাদী আচরণ শিশুদের মন-মনন ও স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার পক্ষে এক প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনা। এই ব্যবস্থাপনার আওতায় শিশুর বিকাশ ও প্রবৃদ্ধি যত সুন্দর উপায়ে হয়, এর বিপরীত আচরণে শিশুর বেড়ে ওঠা হয় ততই কুণ্ঠিত ও আবদ্ধ পরিসরে; যা নয় রাসূলের শিক্ষাও, আবার নয় প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনাও…
ঘটনাসূত্র : সহীহ বুখারী।