রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসা এক রকমের ছিলো না। ভালোবাসায় তিনি ছিলেন রঙিন মানুষ। বহু জনের জন্য তাঁর ভালোবাসা বহু প্রকারের হয়ে শত রঙের বাহার ছড়াতো। তাঁর ভুবনভোলানো ভালোবাসা স্মিতহাস্য নিয়ে ছড়িয়ে পড়তো কত জীবনের কোনায় কোনায়। কানায় কানায় ভরে উঠতো কত ব্যথায় মথিত জীবন।
তাঁর এক স্ত্রী ছিলেন সাফিয়া। খুব ভালোবাসতেন তিনি তাঁকে। তিনি ছিলেন বিখ্যাত এক গোত্র-সরদারের মেয়ে। ভালোবাসার পাশে তিনি রাখতেন মর্যাদাকে। স্তরভেদে একজন মানুষের মর্যাদাপ্রদানকে তিনি প্রাপ্য সম্মান জ্ঞান করতেন। যুদ্ধে তাঁর পরিবারের সবাই নিহত হয়েছিলো। তিনি ছিলেন যুদ্ধবন্দী। ব্যথিত এই নারীকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিয়ে করে তাঁর কষ্টে সান্ত্বনার প্রলেপ মেখে দেন।
একবার রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশকে এতেকাফে বসেন। হযরত সাফিয়া রা. তাঁকে দেখতে যান। কিছু সময় তাঁরা কথাবার্তা বলেন। সেসব কী কথা ছিলো? কী কথা বলেছিলেন তাঁরা একান্তে? সাফিয়া কি সেসব বলে গেছেন? যাননি হয়তো। বললে আমরা পেতাম এই সুন্দর ঘটনাটির মতো। একসময় তাঁদের সেই কথা শেষ হলো। আসলে কি কথা শেষ হয়? সাফিয়া উঠে দাঁড়ালেন। চলে যেতে হবে তাঁকে। নবীজিও উঠে দাঁড়ালেন। না-দাঁড়ালে কিছুই হতো না। কিন্তু আমরা পেতাম না মর্যাদা দেখানোর এমন একটি প্রণতিপ্রাপ্য শিক্ষা। শুধু উঠে দাঁড়িয়েই থামলেন না। সাফিয়া রা. ঘর পর্যন্ত গেলেন। সে পর্যন্ত তাঁকে এগিয়ে দিলেন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কী ভাবছিলেন সাফিয়া তখন? নাকি এমন সৌম্য-সুন্দর মর্যাদায় তাঁরা তত দিনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন?
বিয়ের আয়োজন চলছে। আহামরি কোনো সমারোহ নয়। খুবই সামান্য ভোজনপর্ব। কনে সরদারকন্যা সাফিয়া বিনতে হুয়াই। নবীজির বিয়ে। রুটি-গোশত নয়, দস্তরখানে মাখন পনির আর খেজুর ঢেলে দেওয়া হলো। এই হলো বিয়ের আহার। বিয়ে শেষ। বর-কনে যাত্রা করলেন ঘরের পথে। আনাস রা. বলেন, ‘আমি ও আবু তালহা ছিলাম নবীজির সাথে।’ সাফিয়া রা. ও নবীজি একই উটে বসা ছিলেন। উট পথ চলছে। কিছু দূর গিয়ে হোঁচট খেলো উট। নবীজি ও তাঁর স্ত্রী উভয়ে উট থেকে পড়ে গেলেন। আবু তালহা তড়িৎ নিজ বাহন ছেড়ে নবীজির কাছে এগিয়ে গেলেন। বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহর কসম, আমার জীবন আপনার জন্য কোরবান হোক; আপনি ব্যথা পাননি তো?’ নবীজি বললেন, ‘না, আমার কিছু হয়নি; সাফিয়াকে দ্যাখো।’ আবু তালহা রা. একটি কাপড় আড়াল করে সাফিয়া রা.-এর কাছে গেলেন। কাপড়টি তিনি উম্মুল মুমিনীনের সামনে ধরে রাখলেন। তারপর উভয়কে বাহনে উঠিয়ে দিলেন।
এই গুণগুলো রাসূলকে আলাদা করে ফেলতো আর-সবার থেকে। অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ার এই ধারা শুধু আদর্শের ফাঁপা বুলিতে রয়ে যায়নি ইসলামে; ইসলামী শরীয়তপ্রণেতা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা নিজের ঘরের আওতা থেকেই শিক্ষা দিয়ে গেছেন। শিক্ষণীয় কোনো ব্যাপারকেই তিনি কোনো সমাজ বা গোষ্ঠীর কোনো চক্রে আটকে থাকতে দিতেন না। ছোট-ছোট শুভবোধের আড়ালে তাঁর আকাঙ্ক্ষায় ছিলো একটি আসন্ন মানবিক সভ্যতার উদ্গম।
সাফিয়া রা.-এর জীবনের আরেকটি ঘটনা। কোথাও যাবেন হযরত সাফিয়া বিনতে হুয়াই। তাঁর সামনে বাহন প্রস্তুত। কিন্তু বাহন উঁচু ছিলো বলে তাতে ওঠা সাফিয়া রা.-এর জন্য কঠিন হয়ে পড়লো। নবীজি এগিয়ে এলেন। সাফিয়ার পাশ দিয়ে সরে এসে হাঁটু গেড়ে বসলেন বাহনের সামনে। এখন কী করবেন সাফিয়া? আমরা অবাক হই। কিন্তু সাফিয়া রা. তো চেনেন আল্লাহর রাসূলকে। তিনি তাঁর পা এগিয়ে দিলেন রাসূলের ভাঁজ-করা হাঁটুর দিকে। পায়ের ভর রাখলেন পেতে-দেওয়া হাঁটুতে। তারপর উঠে গেলেন বাহনে।
আজ থেকে হাজার বছরেরও বেশি সময়কার আগের ঘটনা। কালে-কালে ভালোবাসা, সম্মান ও গুরুত্বদানের মহিমা বুঝিয়ে কত-কত পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে। কিন্তু পৃষ্ঠায় লেখা নয়, সময়ের খোড়লে কোঁদানো এই অজর-অমর অক্ষর আজও অবাক করে, ভালো লাগায়, যতবারই মুখোমুখি হই, একই রকম নতুনতা নিয়ে দেখা দেয় আমাদের চোখে…
ঘটনাসূত্র : সহীহ বুখারী