যে দাওয়াত নিয়ে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসেছিলেন, সেই দাওয়াতের ময়দানে টিকে থাকা ছিলো অত্যন্ত ধৈর্য ও হিম্মতের কাজ। তিনি এই ধৈর্য ও হিম্মত সারা জীবন ধরে দেখিয়েছেন। জীবনের এমন কোনো দিন ছিলো না, যেখানে তাঁকে নানা পরিস্থিতে ধৈর্যের পরিচয় দিতে হয়নি। মক্কায় মুশরিকদের নানা অত্যাচারের বিপরীতে ধৈর্যধারণ আর মদীনায় মোনাফেকদের নানা কূটচাল ষড়যন্ত্র আর প্রোপাগান্ডার মুকাবেলায় সহনশীলতার পরিচয় দান—এভাবেই কেটে গেছে তাঁর সারাটি জীবন।
দাওয়াতের ময়দানের এত কষ্ট আর বাধা-বিপত্তির কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো মনোবল হারিয়ে ফেলতেন। কারণ, তিনি তো একজন মানুষই। আর ঠিক তখনই আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাজিল করে দীনের উপর অটল থাকার ব্যাপারে ধৈর্যধারণ করার নির্দেশ দিতেন। যে সকল আয়াতে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ধৈর্যধারণের কথা বলা হয়েছে, তাতে চোখ বুলালেই আন্দাজ করা যায়, দাওয়াতের ময়দানে কী ধৈর্য, অটল মনোবল আর অধ্যবসায় থির করে তাঁকে রাখতে হয়েছিলো।
এক আয়াতে বলা হয়েছে—‘আপনার রবের উদ্দেশ্যে ধৈর্য ধারণ করুন।’ অন্য আয়াতে—‘আপনি অবিচল থাকুন, নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য।’ অন্যত্র—‘ওরা যা কিছু বলে, সে ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করুন এবং ভদ্রভাবে ওদের পরিহার করে চলুন।’ আরও নাজিল হয়েছে—‘অতএব আপনি অবিচল থাকুন, যেমন অবিচল ছিলেন দৃঢ় হিম্মতের অধিকারী রাসূলগণ।’ আল্লাহ বলেছেন—‘আপনি ধৈর্য ধারণ করুন, নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য; আর যারা বিশ্বাস করে না, ওরা যেন আপনাকে কিছুতেই বিচলিত না করে।’ এ ছাড়াও বহু স্থানে নানা প্রেক্ষাপটে নানা বরাতে রাসূলকে বারবার বলা হয়েছে ধৈর্য ধারণের কথা, অবিচলতার কথা, অটল মনোবলে স্থিত থাকার কথা। কারও রক্তচক্ষু, কারও প্ররোচনা, মিথ্যা ও ভুল প্রচারণা—সবকিছু এড়িয়ে কেবল রবের দিকে ধৈর্যশীল এক গন্তব্যের দিকে তাঁকে বারবার আহ্বান করা হয়েছে।
দাওয়াতের অঙ্গনে ধৈর্য হলো এক অপরিহার্য বিষয়। আল্লাহর পথে যাঁরা কৃতকার্য হয়েছেন, তাঁরা সকলেই ধৈর্যের এক সুবিশাল প্রান্তর পাড়ি দিয়ে অবিশ্বাসী ও ষড়যন্ত্রীদের সকল ভ্রুকুটি পাশ কাটিয়ে তবেই সফল হয়েছেন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। অত্যাচার, নির্যাতন, অসহিষ্ণুতা, বিরুদ্ধপ্রচার সবকিছুকে পেরিয়ে তিনি সফলকাম হয়েছেন।
খাব্বাব ইবনুল আরাত রা. বলেন, ‘একবার রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবা শরীফের ছায়ায় চাদরকে বালিশ বানিয়ে বিশ্রাম করছিলেন। আমরা অভিযোগের সুরে তাঁর কাছে আবেদন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য সাহায্য চাইবেন না? আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবেন না? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাদের পূর্ববর্তী ঈমানদারদের অবস্থা এমন ছিলো যে, তাদের জন্য মাটিতে গর্ত খনন করা হতো এবং সেই গর্তে তাদের পুঁতে রেখে করাত দিয়ে মস্তক দ্বিখণ্ডিত করা হতো। এমন নির্যাতনও তাদের দীন থেকে বিচ্যুত করতে পারতো না। লোহার চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে শরীরের হাড় থেকে মাংস ও শিরা-উপশিরা সবকিছু ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করা হতো। এমন কঠিন নির্যাতনের পরেও দীন থেকে তাদের বিমুখ করা সম্ভব হয়নি। আল্লাহর কসম, আল্লাহ এ দীনকে অবশ্যই পূর্ণতা দান করবেন এবং সর্বত্র নিরাপদ ও শান্তিময় অবস্থা বিরাজ করবে। সেদিন একজন উষ্ট্রারোহী সানআ থেকে হাজারামাউত পর্যন্ত ভ্রমণ করবে এবং এ সময় সে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করবে না; অথবা তার মেষপালের উপর নেকড়ের হামলার আশঙ্কাও করবে না। কিন্তু হায়, তোমরা বড়ই তাড়াহুড়া করছো।’
এমন অবিচল মন, উঁচু হিম্মত ও পাহাড়সম ধৈর্য ধারণ করে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনের সুদীর্ঘ ২৩ বছর একনাগাড়ে তাঁর শরীরের রক্ত-ঘাম পানি করেছেন এবং তিনি প্রত্যয় নিয়ে যে কথা বলেছিলেন, আল্লাহর মারফত যতগুলো ওয়াদা তিনি পেয়েছিলেন, সবই তাঁর চোখের সামনে সত্য হয়ে ফলেছিলো। তিনি ছিলেন পৃথিবীময় ধৈর্যের ও অটলতার একমাত্র পুরোধা, আল্লাহর দীন ও ইসলামের স্বার্থে সবচেয়ে ত্যাগী ধৈর্যধারণকারী এক অবাক মহামানব।
ঘটনা ও সূত্র : কুরআন—সূরা মুদ্দাসসির, সূরা গাফির, সূরা মুযযাম্মিল, সূরা আহকাফ, সূরা রুম; সহীহ বুখারী