হালাল-হারাম—এ দুই বিষয় থেকে হালালকে বেছে নেওয়া বা হালালের জন্য অতি সতর্কতায় বেছে পা ফেলা হলো পরহেজগারি। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সবচেয়ে উঁচু স্তরের পরহেজগার। তাঁর মতো পরহেজগার কেউ হতে পারবে না। তিনি আল্লাহর হালাল-হারামের সীমা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানতেন। আর তিনিই এর পার্থক্য সবচেয়ে ভালো বুঝতেন। আর কুরআনে ইরশাদ হয়েছে—‘আল্লাহকে বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই বেশি ভয় করে।’
নুমান ইবনে বশির রা. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হালাল সুস্পষ্ট, হারামও সুস্পষ্ট। মধ্যবর্তী বিষয় হলো সংশয়পূর্ণ, যা বহু মানুষ জানে না। অতএব, যে সংশয় থেকে বেঁচে থাকলো, সে দায়মুক্ত হলো। আর যে সংশয়ে লিপ্ত হলো, সে ওই রাখালের মতো, যে বকরি চরায় সংরক্ষিত ভূমির পাশে, যেখানে যে কোনো মুহূর্তে ঢুকে পড়ার সংশয় রয়েছে। জেনে রেখো, প্রত্যেক বাদশার সংরক্ষিত স্থান থাকে। দুনিয়ায় আল্লাহ তায়ালার সংরক্ষিত স্থান হলো ‘হারাম বিষয়সমূহ’। শোনো, শরীরে এক খণ্ড গোশত আছে, তা যখন ভালো থাকে, তখন শরীর ভালো থাকে। আর যখন তা নষ্ট হয়, তখন শরীর নষ্ট হয়। সেটি হলো হৃদয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ে বলেছেন, যেগুলো তোমাদের জন্য সন্দেহ সৃষ্টি করে, সেগুলোকে সন্দেহমুক্ত বিষয়ের সঙ্গেই ছেড়ে দাও। এখানে রাসূল পরহেজগারির স্বরূপ দেখিয়েছেন। পরহেজগারি হলো, সংশয়পূর্ণ বিষয় থেকে বেঁচে থাকা। কারণ, এর পাশেই রয়েছে হারাম। সংশয়পূর্ণ বিষয়গুলো হারামকে বেষ্টনকারী প্রাচীরের মতো। তাই এগুলো থেকে দূরে থাকলে হারাম থেকে দূরে থাকা সহজ হয়।
নাওয়াস ইবনে সাময়ান রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সৎ কাজ ও গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, উত্তম চরিত্রই হলো সৎ কাজ। আর গুনাহ হলো সেই কাজ, যা করতে তোমার অন্তর বাধা দেয়। আর সে সম্পর্কে মানুষের অবগতি তুমি অপছন্দ করো। রাসূলের এই হাদীসে তিনি ভালো-মন্দ যাচাইয়ের জন্য প্রকৃত চাবিকাঠি এবং সন্দেহযুক্ত বিষয় থেকে বেঁচে থাকার মাপকাঠি ঠিক করে দিয়েছেন; তা হলো, কোনো বিষয়ে মানসিক প্রশান্তি না-পাওয়া এবং সে ব্যাপারে মানুষের অবগতি ভয়ের কারণ হওয়া—এ দুটির কোনো একটি এলে রাসূলের আদর্শ হলো, পরহেজগারি এখতিয়ার করা।
আনাস রা. বলেন, নবীজি কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে একটি খেজুর পেলেন। তিনি বললেন, এটা যদি সদকার খেজুর হওয়ার আশঙ্কা না-থাকতো, তবে আমি এই খেজুর খেয়ে নিতাম।
আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি বাড়িতে গিয়ে বিছানায় খেজুর পড়ে থাকতে দেখি। খাওয়ার জন্য হাতেও নিই। কিন্তু তা হতে পারে সদকার খেজুর, এই আশঙ্কায় আবার রেখে দিই।
হাদীসে একটি ঘটনার বিবরণ আছে। এক নারী নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে খাবারের দাওয়াত জানালেন। তিনি উপস্থিত হলে খাবার পরিবেশন করা হলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেতে গিয়ে হাত বাড়ালেন। এরপর সাহাবীগণ খাওয়া শুরু করলেন। সাহাবীগণ লক্ষ করলেন, নবীজি একটি লোকমা মুখে দিয়ে চাবাচ্ছেন। তারপর তিনি বললেন, তুমি ছাগলের গোশত মালিকের অনুমতি ছাড়াই আমাদের খেতে দিয়েছো। নারীটি বললো, আল্লাহর রাসূল, আমি বাজারে খাদেম পাঠিয়েছিলাম ছাগল কেনার জন্য। কিন্তু বাজারে ছাগল পাওয়া যায়নি। আমার এক প্রতিবেশী ছাগল কিনেছিলো। আমি ছাগলটি কেনার জন্য খাদেম পাঠালাম। তাকে পাওয়া গেলো না। তাই আমি প্রতিবেশীর স্ত্রীর কাছে লোক পাঠালাম। সে ছাগলটি পাঠিয়ে দিলো। সব শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, গোশতগুলো বন্দিদের খাইয়ে দাও।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার আবু হুরায়রা রা.-কে বলেন, তুমি পরহেজ করে চলো, তাহলে সবচেয়ে বেশি ইবাদতগুজার বান্দা বলে গণ্য হবে। তিনি পরহেজগারির বিলুপ্তি হয়ে যাবে, এমন যুগের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, অবশ্যই এমন একটা যুগ আসবে, যখন মানুষ হালাল-হারাম কোনো কিছুই গ্রহণ করতে পরোয়া করবে না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসে বলেছেন, যে ব্যক্তি হালাল-হারামের পরোয়া করে চলে না, তার দোয়া কবুল হয় না। অথচ রাসূলেরই কথা হলো, দোয়া ইবাদতের মগজ। পরহেজগারি সম্পর্কে রাসূলের এসব নির্দেশ, গুরুত্বপ্রদান, হুঁশিয়ারি—সবকিছু মূলত রাসূলের জীবনের যে ছবি, তারই প্রকাশ।
ঘটনা ও সূত্র : বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ।