নবীজির রসিকতা ও রসবোধ

রসিকতা একটি বৈধ বিনোদন-ব্যবস্থা। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও রসিকতা করতেন। জীবনের প্রতিটি স্বভাবজাত প্রাকৃতিক ও মানবিক চাহিদার প্রতি তাঁর যেমন খেয়াল ছিলো, ঠিক তেমনি সেসব চাহিদার আওতা কতটুকু হবে, সে ব্যাপারেও তিনি সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন; সেমতে রসিকতার ব্যাপারেও তিনি পরিমিতি ও ঔচিত্যের কিছু ভেদরেখা রেখেছেন। রসিকতা করা গেলেও লোক হাসানোর জন্য কোনো মিথ্যা কথা বলা যাবে না। হাদীসে এমন মিথ্যাবাদীর পরিণাম খুব ভয়াবহ বলা হয়েছে। আবার এমন রসিকতাও করা যাবে না, যে রসিকতায় কারও সম্মানহানি হয় বা কেউ কষ্ট পায়। এসব সীমার মধ্যে থেকে রসিকতা কোনো খারাপ ব্যাপার নয়; বরং রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনেও ছিলো সুপরিমিত রসিকতা বা রসবোধের উপস্থিতি।

নবীজির এক সাহাবী, হানযালা রা. একসময় ভেবে বসলেন, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত হাস্যরসহীন কঠোর নিয়ম ও আল্লাহর নিরবচ্ছিন্ন সাধনায় কাটিয়ে দিতে হবে। এমনকি পরিবারের সাথে হাসি-কৌতুক ও আমোদকেও তিনি আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফলতি আর মুনাফেক হওয়ার আলামত বিবেচনা করে রাসূলের কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ আনলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কথা শুনলেন। বললেন, ‘হানযালা, কখনো-কখনো হাসি-আনন্দেরও প্রয়োজন আছে।’

আবু হুরায়রা রা. বলেন, ‘সাহাবীরা একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনি যে আমাদের সাথে রসিকতা করে থাকেন! নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি সত্য ছাড়া অন্য কিছু বলি না।’ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, আমার যে রসিকতা, তাও সত্য-বর্জিত কোনো ব্যাপার নয়।

এক লোক একবার নবীজির দরবারে এলো। নিজের প্রয়োজন পূরণার্থে রাসূলকে বললো, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে একটি উটের সওয়ারি দিন।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমি তোমাকে একটি উটনীর বাচ্চা দেবো।’ লোকটি বললো, ‘উটনীর বাচ্চা দিয়ে আমি কী করবো?’ রাসূল বললেন, ‘প্রত্যেকটি উটই তো কোনো না কোনো উটনীর বাচ্চা।’ রাসূলের কৌতুক ছিলো এমনই সূক্ষ্ম ও বাস্তবতামিশ্রিত। কোনো অবাস্তব অলীক বিষয় তাঁর রসিকতায় স্থান পেতো না।

নবীজির খাদেম আনাস রা.-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার বললেন, ‘ওহে দুই কানঅলা।’ উসামা রা. বলেন, ‘ওটা ছিলো নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রসিকতা।’

এক বৃদ্ধা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এলো। বললো, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমার জন্য জান্নাতের দোয়া করে দিন।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হে অমুকের মা, কোনো বৃদ্ধা তো জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ শুনে বৃদ্ধা কাঁদতে লাগলো। নবীজি মজা পেলেন। বললেন, ‘ওকে জানিয়ে দাও, কোনো বৃদ্ধাই জান্নাতে প্রবেশ করবে না। সকল বৃদ্ধাই যুবতী হয়ে পরে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’

যাহের নামের এক সাহাবী গ্রাম থেকে নবীজির কাছে আসতো। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য নানা কিছু হাদিয়া নিয়ে আসতেন। রাসূল তাঁকে অনেক ভালোবাসতেন। যখন তাঁর গ্রামে ফেরার সময় হতো, রাসূল কারীমে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মাল-সামানা গুছিয়ে দিতেন। আর বলতেন, ‘যাহের আমাদের গেঁয়ো ভাই আর আমরা যাহেরের শহুরে ভাই।’

মদীনার বাজারে যাহের নানা পণ্য বিক্রি করতেন। একবার রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লুকিয়ে তাঁর পেছন থেকে এসে তাঁকে জাপটে ধরলেন। তিনি নড়তে পারছিলেন না। আবার এও দেখতে পারছিলেন না, কে তাঁকে এভাবে ধরেছে। তিনি বলছিলেন, ‘ছাড়ো, আমাকে ছাড়ো।’ একটু পরেই তিনি টের পেলেন জাপটে-ধরা ব্যক্তিটি নবীজি। তখন তিনি আর ছোটার চেষ্টা করলেন না। তাঁর পিঠ রাসূলের বুকের সাথে লেগে ছিলো। রাসূল বলতে লাগলেন, ‘কে আছো, আমার এই গোলামটাকে কিনবে?’ যাহের বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমি তো ত্রুটিযুক্ত মানুষ; আমাকে আপনি বেশি দামে বেচতে পারবেন না।’ নবীজি বললেন, ‘কিন্তু তুমি আল্লাহর কাছে অল্প-দামি নও।’

এভাবে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিমিত পরিমাণে, বৈধতা ও ঔচিত্যের সীমায় থেকে রসিকতা করতেন। সাহাবীদের করতে দেখলে নিষেধ করতেন না। মানবিক আচার হিসেবে রসিকতাকেও তিনি সত্যের সুন্দরে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছিলেন।

ঘটনা ও সূত্র : বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী