মনযূরুল হক
কথা মানুষের ব্যক্তিত্ব প্রকাশের সবচে’ বড় অনুষঙ্গ। কখনো একটি কথাই মানুষের পূর্ণ ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করে দেয়। নবীজির চলাফেরার ধরন ও অন্যান্য প্রকৃতির বাক-ভঙ্গিমাও ছিল স্মরণীয়। নবীজির একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিলো মানুষের সামনে বক্তব্য প্রদান করা এবং যে-কোনো বিষয় স্পষ্ট করা। যেমন আল্লাহ বলেন— وَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ (এবং আপনার প্রতি এই স্মারক (তথা কুরআন) অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষের সামনে তা স্পষ্ট করে দেন, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে, এবং যাতে তারা গভীরভাবে চিন্তা করে)। [1.(সূরা নাহল, আয়াত, ৪৪)]
বক্তব্য কখনো কথার মাধ্যমে, কখনো কাজের মাধ্যমেও জানানো যায়, আবার কখনো কোনো কাজের মৌনসমর্থন দানের মাধ্যমেও নিজের বক্তব্য বোঝানো যায়। যদিও কথার মাধ্যমে বক্তব্য দানটিই অগ্রাধিকার পায়। এই কথা বলাটা কখনো মজলিসে, কখনো বিশেষ উপলক্ষে উপযুক্ত উপদেশ কিংবা ভাষণের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
যেভাবে কথা বলতেন
নবীজি স. কথা বলতেন সুস্পষ্টভাবে ও সবিস্তারে। শ্রোতামাত্রই তার কথা বুঝত এবং আয়ত্ত করতে পারত। আয়েশা রা. বলেন— তিনি এমনভাবে কথা বলতেন যে, কেউ গুণতে চাইলে গুণতে পারত। [2.(বুখারি, হাদিস ৩৫৬৮)] তোমরা যেমন দ্রুত কথা বল, তিনি তেমন দ্রুত বলতেন না। তিনি কথা বলতেন থেমে থেমে। প্রত্যেক শ্রোতা তার কথা বুঝতে পারত। [3.(তিরমিজি, হাদিস ৩৬৩৯)]
আনাস রা. বলেন— নবীজি স. একটি কথা তিনবার পুনরাবৃত্তি করতেন, যেনো তা বুঝে নেওয়া যায়। [4.(বুখারি, হাদিস ৯৫)]
যেভাবে উপদেশ দিতেন
সাহাবীদের তিনি উপদেশ দিতেন বটে, কিন্তু অতিরঞ্জন করতেন না। তার উপদেশ ছিলো অত্যন্ত প্রভাবমণ্ডিত, হৃদয়গ্রাহী এবং বিবেক জাগানিয়া। ইবনে মাসউদ রা. বলেন— নবীজি স. আমাদের উপদেশ দিতেন মাঝেমধ্যে, যেনো আমরা বিরক্ত না হই। [4.(বুখারি, হাদিস ৬৮)] ইরবাজ ইবনে সারিয়া রা. বলেন— একদিন নবীজি স. আমাদের নামাজ পড়ালেন। তারপর আমাদের দিকে ফিরলেন এবং প্রভাবপূর্ণ উপদেশ দিলেন। আমাদের চোখ অশ্রুসিক্ত হলো, অন্তর ভীত হয়ে উঠল। [5.(আবু দাউদ, হাদিস ৪৬০৭)]
তার উপদেশের ধরন বর্ণনা করে হামযা রা. বলেন— তিনি আমাদের জান্নাত-জাহান্নামের কথা আলোচনা করতেন এমনভাবে, যেনো সেগুলো আমরা চোখের সামনে…। [6.(মুসলিম, হাদিস ২৭৫০)]
যেভাবে ভাষণ দিতেন
দুর্যোগকালে অধিকাংশ সময় নবীজি স. সাহাবিদের সমবেত করে ভাষণ দিতেন। নবীজি স. ছিলেন একজন সেরামানের বাগ্মী ও বক্তা। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. বলেন— নবীজি স. যখন ভাষণ দিতেন, তখন তার চোখ লাল হয়ে যেতো, আওয়াজ উচ্চকিত হতো এবং তার রাগ তীব্র হতো। মনে হতো যেনো কোনো সৈন্যদলকে সতর্ককারী বলছে, শত্রু তোমাদের ওপর সকালে বা সন্ধ্যায় ঝাঁপিয়ে পড়বে। [7.(মুসলিম, হাদিস ৮৬৭)]
ইবনে ওমর রা. বলেন— নবীজি বলছিলেন, আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন আকাশমণ্ডলি গুটিয়ে নেবেন। এরপর ডান হাতে একে ধরবেন আর বলবেন, আমিই মালিক। কোথায় অহঙ্কারীরা? কোথায় দম্ভকারীরা? এরপর জমিনকে বাম হাতে গুটিয়ে নেবেন আর বলবেন, কোথায় অহংকারীরা? কোথায় দম্ভকারীরা? ইবনে ওমর রা. বলেন— দেখলাম, ভাষণের প্রচ-তায় মিম্বর নীচ থেকে দুলছে। এমনকি আমি বলবাভাবছি, মিম্বরটি কি নবীজিকে নিয়ে পড়ে যাবে? [8.( বুখারি, হাদিস ৭৩১২)]
নোমান ইবনে বাশীর রা. বলেন— নবীজি স.-কে ভাষণে বললেন, আমি তোমাদের জাহান্নামের ভয় দেখাচ্ছি..। (এত জোরে বললেন যে,) কেউ বাজারে থাকলেও সেখান থেকে এ-আওয়াজ শুনতে পেতো। এমনকি তার কাঁধ থেকে চাদরটি পায়ের গোড়ায় পড়ে গেলো। [9.(আহমাদ ও মাজমাউয যাওয়ায়েদ)] বিদায় হজের ভাষণের সময় একটি চাদর তার বগলের নীচ ও কাঁধের ওপর দিয়ে পেঁচানো ছিলো। উম্মে মাহাসান বলেন, তখন আমি দেখলাম, তার বাহুর মাংসপেশি কাঁপছে। [10.(তিরমিজি, হাদিস ১৭০৬)]