নিরুপম নিরালা নবী—মুহাম্মদ

মক্কার দিকে ধেয়ে আসছে মুসলিমরা, একদিন তাঁদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো যে শহর থেকে। আজ তাঁরা বিপুল পরাক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে মক্কার দিকে,—যে মক্কাকে পেছনে ফেলে, এবং পেছনে ফেলে আরও অনেক স্মৃতি ও বিস্মৃতির করুণ বিষণ্ন ঝরাপাতা, তাঁরা বের হয়ে হয়ে গিয়েছিলো একদা;—বের হয়ে গিয়েছিলো স্বজাতির ক্রোধ-উষ্মা-ষড়যন্ত্র আর দশ-দিক-ঘেরা অত্যাচার ও পীড়নের হাত থেকে বেঁচে এক আল্লাহর বন্দেগি করার নিরাপদ ভূমির আশ্বাস ও আস্থা নিয়ে। তাঁরা চলে গিয়েছিলো মক্কা থেকে দূরের এক শহর ইয়াসরিবে। নবীর পদস্পর্শে যে শহর হয়ে উঠেছিলো মদীনাতুন নবী—এককথায় মদীনা।

তারপর কেটে গেছে অনেক বছর। দিন-রাতের অনেক পালাবদল ঘটেছে। বদর উহুদ খন্দকের বিভীষিকাময় সেই কঠিন-রুদ্র দিনেরাও আজ স্মৃতি। কত জন, কত স্বজন, কত বন্ধু আর নেই; চলে গেছে ওপারের পথে। দিন থেমে থাকে না। একেক দিন আসে একেক রূপ ও পরিচয় নিয়ে। একদিন মক্কা ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া সেই তাওহিদবিশ্বাসী ভীত ব্যথিত ও নিরুপায় দলটি আজ আর নয় ভীত ব্যথিত বা নিরুপায়। তাঁরা আজ পরাক্রান্ত, জন্মশহর বিজয়ের আশায় উদ্বেলিত, আশাবাদের ঝিলমিল তাঁদের চোখে;—বরং তাঁরা আসন্ন বিজয়ের ব্যাপারে সুনিশ্চিত।

হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে মক্কাবাসীরা। না জানি কোন শনি আজ নেমে আসবে তাদের উপরে। মুসলিমদের পরাক্রম আজ দিকেদিকে। দুর্বল অসমর্থ মুষ্টিমেয় দলটি আর তাঁরা নয়। কোন এক অসীম শক্তির দাপটে নিজেদের অকুতোভয়তাকে তাঁরা করে তুলেছে কিংবদন্তী। একদিন, এই দলটিকেই বের করে দিয়েছিলো তারা। সেই জের আজ কীভাবে নেমে আসবে বজ্র হয়ে, স্ফুলিঙ্গ হয়ে নাকিবা তরবারির রক্তনেশা নিয়ে—এসব ভাবতে-ভাবতে পালাচ্ছে মক্কাবাসী। খুঁজে ফিরছে একটু নিরাপদ ঠাঁই, যেখানে অন্তত নেমে আসবে না মুসলিমদের মরণকামড়।

এক বুড়ি। একটা বোঁচকা পাশে নিয়ে পড়ে আছে। ভয়ে বিহ্বল আর বয়সে ন্যুব্জ বুড়ি বুঝতে পারছে না, কী করবে? তটস্থ কাফেলা তাকে ফেলে চলে গেছে প্রাণের মায়ায়। মুসলিমদের আসার খবর রটে গেছে। ঘাড়ের উপর লু শ্বাস ফেলছে ঊর্ধ্বশ্বাস ঘোড়ার মতো। জীবন বুঝি এই ঘনিয়ে এলো—প্রমাদ গুনলো বুড়ি। নৃশংস মুহাম্মদের হাত থেকে আর রক্ষা নেই বুঝেও বার্ধ্যক্যের ভরে পড়ে রইলো মুখ থুবড়ে।

বুড়ির সামনে এক লোক দাঁড়িয়ে। মুখ তুলে চাইলো বুড়ি। বিড়বিড় করে বিরক্তি ভরে কুঞ্চিত ভ্রুতে বললো, ‘তুমি তো মুসলিম!’ লোকটি বললেন, ‘হ্যাঁ, বুড়িমা; মুসলিম আমি।’ বুড়ি হোবলের নাম ধরে অভিশাপ দিলো লোকটিকে। লোকটি নুয়ে বললেন, ‘অভিশাপ দাও, দাও; কিন্তু আমি তো তোমাকে ফেলে যেতে পারি না, বুড়িমা।’ কিছুটা যেন আশা পেলো বুড়ি। লোকটির হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো। বললো, ‘আমায় নিরাপদ এক জায়গায় নিয়ে যাবে? একটু পরেই তাণ্ডব শুরু হবে মুসলিমদের।’ লোকটি বললেন, ‘চলো। কিন্তু কই তাণ্ডব? কিচ্ছু হবে না।’ বিড়বিড় করতে লাগলো বুড়ি—‘হবে, হবে; মুহাম্মদ আসবে। সব ধ্বংস হয়ে যাবে। হোবলের নাম মুছে যাবে…’

লোকটি বুড়িকে এক আড়ালে নিয়ে এলো। প্রসন্ন বুড়ি লোকটির দিকে চেয়ে বললো,—যেনবা কিছুটা লজ্জায়— ‘আমারও তোমার মতো একটি ছেলে ছিলো…’—বলেই করুণ হয়ে উঠলো বুড়ির চেহারা। লোকটি বললেন, ‘আমিও তোমার ছেলে, বুড়িমা।’ কিন্তু সেই করুণ ভয়ার্ত ছায়া তাতে মিলিয়ে গেলো না। বুড়ি লোকটির হাত ধরে বললো, ‘মুহাম্মদ কি ধ্বংস নিয়ে আসছে না?’ লোকটি নরম করে—নীলকণ্ঠ পাখি যেন—বললো, ‘বুড়িমা, আমিই তো মুহাম্মদ।’ ঝটকায় হাত সরে গেলো বুড়ির। পিছিয়ে পড়া শরীর নিয়ে সে অবিশ্বাস আর দ্বিধা নিয়ে তাকিয়ে রইলো লোকটির দিকে…

বুড়ির মুখে কথা সরে না। সে মুহাম্মদের হাতে মাথা ঝুঁকিয়ে কেবলই কাঁদছে—বলছে, ‘তুমি মুহাম্মদ?—তুমি! তবে যে ওরা বলতো…’—আবারও হুড়মুড় কান্নায় ভেঙে পড়ে বুড়ি। এমন মুহাম্মদের কথা সে শোনেনি। এমন মহৎ উদার, বিজয়ী কিন্তু বিনয়ী এই অনুপম মুহাম্মদের কথা তাকে কেউ কোনো দিন বলেনি…