বন্ধুত্বের সম্পর্ক অটুট রাখা, অনুপস্থিতিতেও বন্ধুতাকে না-ভুলে যাওয়া, বন্ধুর পরিচিতজনকেও সমাদর করা—এসব হলো প্রতিশ্রুত সম্পর্ক বা বন্ধুতার প্রতি সম্মান ও কৃতজ্ঞতাবোধ। মানবিক গুণাবলির এমন কোনো ভালো গুণ নেই, যার চূড়ান্ত প্রকাশ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে ছিলো না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুরো জীবনে এমন কয়েকজন মানুষের উপস্থিতি ছিলো, যাঁরা একসময় গত হয়ে গেলেও ওই বিগত মানুষদের প্রতি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মান, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতাবোধ তখনকার সময়ের জীবিত মানুষকেও ছুঁয়ে যেতো, প্রভাবিত করতো। নবীজির স্ত্রী হযরত খাদিজা রা. ছিলেন সেই বিরলতম মানুষদের একজন, যাঁরা বিগত হলেও তাঁদের স্মৃতি ও প্রীতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা জীবন ভর মনে রেখেছিলেন।
হযরত আয়েশা রা. বলেন, ‘নবীজির স্ত্রীদের মধ্যে খাদিজার মতো অন্য কাউকে আমার এত ঈর্ষা হয়নি, অথচ তিনি ছিলেন একজন বিগত মানুষ। আমার বিয়েও হয়েছিলো তাঁর ইন্তেকালের পর। তিনি প্রায়ই তাঁর কথা বলতেন। তাঁর সাথে যাঁদের সম্পর্ক ছিলো, তাঁদেরও তিনি সম্মান করতেন।’
খাদিজা রা.-এর কথা নবীজির থেকে-থেকেই মনে পড়তো। নবীজি কোনো দিনই খাদিজা রা.-কে ভুলতে পারেননি। খাদিজা রা. ছিলেন নবীজির খুব কাছের এক বন্ধু। নবীজি যাঁর কাছে নিজের বিহ্বল জীবনের সব ঝঞ্ঝা নিয়ে বসতে পারতেন। নবীজির নবুওতের দাওয়াত তাঁর এই পরম বন্ধুটিই মানবকুলের মধ্যে সর্বপ্রথম গ্রহণ করেছিলেন। তা-ই নয় শুধু, নবুওতের সেই কঠিন-প্রথম সময়ে খাদিজাই ছিলেন নবীজির একমাত্র পার্শ্ববর্তিনী। এইসব স্মৃতি, জীবনের অম্ল-মধুরতম বন্ধুতার বীথি হয়ে তাঁর হৃদয়ে সবসময়েই বিরাজিত ছিলো। কখনো কোনো দিন কোনো বকরি জবাই করলে সেই বকরির উল্লেখযোগ্য অংশ পাঠাতেন খাদিজা রা.-এর বান্ধবীদের বাড়িতে।
একবার জিবরীল আলাইহিস সালাম নবীজিকে বললেন, ‘ওই তো খাদিজা আসছেন। তাঁর সাথে ছোট একটা পাত্র। তাতে আছে কিছু খাবার আর পানীয়। তিনি যখন আপনার সামনে আসবেন, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে সালাম জানাবেন, আমার হয়ে সালাম দেবেন। তাঁকে বলবেন, তাঁর জন্য রয়েছে প্রবালনির্মিত প্রাসাদের সুসংবাদ, সেখানে কোনো দুঃখ-ব্যথা থাকবে না।’
আয়েশা রা. বলেন, ‘নবীজির খাদিজার প্রতি এত অনুরাগ দেখে আমি বলেছিলাম, সে ছাড়া যেন আপনার আর কোনো স্ত্রী নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, সে এমনই। তাঁর গর্ভে আমার সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে।’
একবার হলো কী, খাদিজা রা.-এর বোন হালা নবীজির ঘরে ঢোকার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু আচমকা নবীজির মনে হলো, যেন এ খাদিজা। তিনি চমকে উঠলেন। পরক্ষণে বললেন, হায় আল্লাহ, এ তো হালা। আয়েশা রা. বলেন, ‘এ অবস্থা দেখে আমার খুব ঈর্ষা হলো। নবীজিকে বললাম, কুরাইশের এই বৃদ্ধ নারী, যাঁর গাল দুটো টুকটুকে লাল, তাঁর কথা আর কত ভাববেন? অথচ তিনি বহু আগেই মারা গেছেন। তাঁর থেকে উত্তম স্ত্রী আল্লাহ আপনাকে দিয়েছেন।’
আলী রা. বলেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, শ্রেষ্ঠ নারী দু জন, মারইয়াম আলাইহাস সালাম ও খাদিজা রা.।
এক বৃদ্ধা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলে রাসূল তাঁকে খুব সমীহ করলেন। এই বৃদ্ধা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, মহিলাটি খাদিজা বেঁচে থাকা অবস্থায় আমাদের ঘরে আসতেন। শুধু এই সূত্রিতায় নবীজি বৃদ্ধাকে এমন সম্মান দিলেন যে, বৃদ্ধা সম্পর্কে লোকেদের কৌতূহল হলো। এই তবে ভালোবাসা, এই তবে বন্ধুতা, এই তবে বন্ধুতার হিম-গাঢ় স্মৃতিতারে মনে রাখা।
এমনই এক প্রগাঢ় কৃতজ্ঞতাবোধ ছিলো খাদিজা রা.-এর প্রতি নবীজির, যখন তিনি চলে গেলেন, আর পাশে নেই, রাসূল বিমূঢ় হয়ে পড়লেন, অক্ষম এক ব্যথা শীতের মতো হিম নিয়ে তাঁকে কাবু করে ফেললো। শোক তাঁর সরছিলো না কিছুতেই। যে বছর মারা গেলেন নবীজির এই পার্শ্ববর্তিনী বন্ধুটি, সে বছরের নাম দিলেন তিনি ‘আম্মুল হুযুন—শোকের বছর’।
ঘটনাসূত্র : মুসতাদরাকে হাকেম, বুখারী, মুসলিম, শরহে যুরকানী আলাল মাওয়াহিব