রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুরোটা জীবনই সৌন্দর্যের এমন বিচিত্রতায় ভরা ছিলো, যেন তাঁর জীবনের মোহময় অবিরল আঁচল মোহনীয় আঙুল তুলে ডেকে বলছে, নিবেদনের আকুল-করা পথ থেমে গেছে এখানেই, এখানেই, এখানেই।
যখন আমরা পিতা হিসেবে ভুলে যাই আমাদের পিতৃদায়িত্ব, যখন আমরা বন্ধু হিসেবে ভুলে যাই আমাদের বন্ধুকৃত্য, যখন মনিব হিসেবে ভুলে থাকি ভৃত্যের আর্তি, যখন আমরা মানুষ হিসেবে ভুলে যাই মানুষ হিসেবে আমাদের দায় ও কর্তব্য, তখন রাসূলের মোহন-মহান জীবনের ইশারা অন্ধকার চোরাগলির বাঁকাপথ থেকে এক সরল সরণির আলোমাখা পথের দিকে আমাদের আহ্বান করে; আমাদের কীটদষ্ট নষ্ট জীবন এক অমেয় জীবনের পথে খুঁজে পায় বেদনার উপশম।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন এত কোমল, ভদ্র ও মমতাময় প্রেমিক মানুষ, যা তাঁর বাইরের কর্মব্যস্ত জীবনের সাথে মিলিয়ে গার্হস্থ্য জীবনের দিকে তাকালে আরও পরিপূর্ণ, পরিণত ও বিরলতম অবয়বে ফুটে ওঠে। গৃহকোণের সরলতম মুহূর্তটিকেও তিনি মহাকালের অজর কবিতায় কীভাবে বাঙ্ময় করে তোলেন, তা গভীর অন্বেষা নিয়ে না তাকালে সৌন্দর্যের সবগুলো পাপড়ি মেলে তাকায় না।
এমনই একটি বিরল ঘটনার কথা বলেছেন উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা.। একবার তিনি বলে উঠলেন, ‘আমি কি আমার আর নবীজির একটা ঘটনা তোমাদেরকে বলবো? সকলে এমন আগ্রহকর প্রশ্ন শুনে তো উৎসুক; বলে উঠলেন, অবশ্যই বলুন; আমরা শুনতে চাই। আয়েশা রা. বলা শুরু করলেন…
এক রাতে নবীজি আমার সাথে ছিলেন। শোবার সময় হলো। তিনি তাঁর চাদর ও জুতো খুলে পায়ের কাছে রাখলেন। জীর্ণ বিছানায় ক্ষীণতম স্থানের সংকুলান। ওটুকুতেই রাসূল নিজের লুঙ্গির একটি অংশ বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন। অনেকটা সময় কেটে গেলো। তিনি ভাবলেন, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। আসলে আমি তখনও সজাগ। আমার জাগৃতি বুঝতে না-পেরে রাসূলুল্লাহ সাবধানে উঠে বসলেন। তাঁকে খুব সতর্ক মনে হলো। আস্তে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠলেন, যেন আমি টের না পাই। তারপর খুব সতর্কতায় তিনি জুতো আর চাদর নিলেন। দরজা খুললেন। বাইরে রাত্রির নিঃসীম নীরবতা। সেই নীরবতায় তিনি বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে খুব আস্তে ভেজিয়ে দিলেন দরজার কপাট।
আমি ওড়না পরলাম। পরনের চেনা বেশ-ভূষা বদলে ফেললাম। তাঁর পিছু নেবো, এমন আমার চিন্তা। নিজেকে আড়াল করে আমি তাঁর পিছু নিলাম। দেখলাম, তিনি জান্নাতুল বাকিতে গিয়ে পৌঁছেছেন। লম্বা সময় সেখানে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনবার হাত তুললেন। তারপর তিনি ঘুরে দাঁড়ালে আমিও ঘুরে দাঁড়ালাম। তিনি বাড়ির দিকে দ্রুত ফিরে আসছিলেন, আমিও দ্রতলয়ে পা চালালাম। খেয়াল করলাম, তিনি আরও জোরে চলছেন; আমিও চলার গতি বাড়িয়ে দিলাম। যখন তিনি ঘরের কাছাকাছি হলেন, ততক্ষণে আমি ঘরে পৌঁছে গেছি।
আমি সবে শুয়েছি। এর ভেতর তিনি ঘরে এসে ঢুকলেন। বললেন, ‘আয়েশা, কী হয়েছে তোমার? এমন হাঁপাচ্ছো কেন?’ আমি নিজেকে লুকোতে চাইলাম। বললাম, কিছুই হয়নি। নবীজি বললেন, ‘ঠিক করে বলো; তুমি না-বললেও খুব শিগগির সবকিছু আমাকে জানিয়ে দেওয়া হবে।’ আর কথা লুকোনোর উপায় ছিলো না। তা সঙ্গতও হতো না। আমি বললাম, ‘আমার মা-বাবা আপনার নামে কোরবান হোক।’ তারপর সবকিছুই তাঁর কাছে বিশদ করলাম।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমিই কি সেই কালো ছায়া, যা আমি আমার সামনে দেখেছি?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’ শুনে নবীজি আমার বুকে মৃদু আঘাত করলেন। আমি কিছুটা ব্যথাও পেলাম। তিনি মর্মাহত স্বরে বললেন, ‘তোমার এমন মনে হলো, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার উপর অন্যায় করবেন?’ আমি বললাম, ‘মানুষ যা গোপন করে, আল্লাহ তো তা জানেন।’ তিনি বললেন, ‘নিঃসন্দেহে।’
তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘যখন তুমি আমাকে দেখছিলে, তখন জিবরীল আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি আমাকে একাকী ডাকলেন। আমি সাড়া দিয়ে তাঁর সাথে দেখা করলাম। তোমার কাপড় শিথিল হয়েছিলো বলে তিনি ঘরের ভেতরে আসেননি; তাই গোপনে যেতে হয়েছে তাঁর কাছে। আমি ভেবেছিলাম, তুমি ঘুমিয়ে পড়েছো। তোমাকে জাগাতে ইচ্ছে হলো না। মনে হলো, বিরক্ত হতে পারো। জিবরীল আমিন বললেন, আপনার রব আপনাকে নির্দেশ দিয়েছেন জান্নাতুল বাকির অধিবাসীদের জন্য মাগফেরাতের দোয়া করতে। …’
কী আশ্চর্য ভদ্রতা ছিলো এই মানুষটির। স্ত্রীর আরাম, বিরক্তি, বিব্রতিও তাঁকে কত উৎকর্ণ করে রাখতো, অথচ যিনি কিনা ছিলেন তাঁর যাপিত জীবনের নিত্য দিনের সহচরী—তাঁর সাথেও এমন উপমাবিরল ভদ্রতা—আমরা তো এভাবেই ভাবি; কিন্তু তিনি করে দেখিয়েছেন, আমরা যা ভাবি, করি, দেখাই, তার বাইরেও সুন্দরতম একটি দিক রয়ে গেছে…।
ঘটনাসূত্র : সহীহ মুসলিম।