আমাদের পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাবে নানা সমস্যায় আমরা জর্জরিত। বলা যায়, ব্যাক্তিক, ব্যাবসায়িক ও সামাজিকভাবে যে সমস্যা ও সংকটের শিকার আমরা হই, তার অনেকাংশ ঘটে নিজেদের মধ্যকার পরামর্শ বা বোঝাপড়ার অভাবে। অথচ, যদি এর বিপরীত পথে আমরা হাঁটতাম, তাহলে অনেক সংকট ও সমস্যা থেকে বেঁচে যেতাম। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন পারস্পরিক পরামর্শকে। রাষ্ট্রীয় কাজ থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত জীবনের আপাত-তুচ্ছ ঘটনায়ও তিনি পরামর্শকে গুরুত্ব দিতেন। এমনকি, ইসলামের শুরুর যুগেই আল্লাহ তায়ালা পরামর্শের প্রতি গুরুত্ব-আরোপ করে কুরআনে বলেছেন—‘তাদের কাজকর্ম যেন হয় পারস্পরিক পরামর্শক্রমে।’ রাসূলের সমগ্র জীবনের ঘটনাপঞ্জি চোখের সামনে আনলে আমরা দেখবো, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা জীবন ধরেই কত গুরুত্ব দিয়ে এই আমলের পাবন্দি করে গেছেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের সাথে সবচেয়ে বেশি পরামর্শ করতেন। পরামর্শের নির্দেশ-সংক্রান্ত যে আয়াত, সে আয়াতটি মুসলিমদের উপর তখন নাযিল হয়েছে, যখন মুসলমানদের স্বতন্ত্র কোনো রাষ্ট্র হয়নি, এমনকি মুসলিম-অমুসলিমদের মধ্যে কোনো যুদ্ধের ঘোষণাও হয়নি। তারপরও এই কাজের নির্দেশটি এসেছিলো। এসেছিলো–গুরুত্বপূর্ণ কাজে যেমন পরামর্শের অপরিহার্যতা রয়েছে, তেমনি রয়েছে তদপেক্ষা কম গুরুত্বপূর্ণ কাজেও–এই শিক্ষাটি উপলব্ধি করানোর জন্য। কুরআনের এই নির্দেশের পাবন্দির ফলে মুসলিমরা যে প্রভূত উন্নতি লাভ করেছিলো, এর বিয়োগে সে উন্নতি সাধন হতো না। যার নমুনা আমরা আমাদের সমাজের নানা অংশে দেখতে পাই।
বদর যুদ্ধের দিন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের কাছে পরামর্শ চেয়ে বলেছিলেন, ‘হে লোকসকল, আমাকে পরামর্শ দাও।’ এরপর কয়েকজন আনসার ও মুহাজির সাহাবীর সাথে মতবিনিময়ের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। যুদ্ধক্ষেত্রের স্থান নির্ধারণের ব্যাপারে তিনি হাব্বাব ইবনে মুনযির রা. নামের এক সাহাবীর সাথে পরামর্শ করেন। এরপর গনিমতের ব্যাপারেও পরামর্শ করা হয়।
উহুদ যুদ্ধেও রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করেছিলেন। তাঁদের মত ছিলো যুদ্ধে যাওয়ার পক্ষে। কিন্তু নবীজির মত ছিলো মদীনায় থেকে যাওয়ার পক্ষে। এরপরও তিনি নিজ মত পরিত্যাগ করে মদীনার বাইরে গিয়েছিলেন। ফল কী হয়েছিলো, তা সকলেই জানে। কিন্তু এই পরাজয়ের পরেও, যেহেতু এই কাজটি তিনি করেছিলেন পরামর্শের ভিত্তিতে, তাই কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন—‘হে নবী, এসব ঘটনার পর এটা আল্লাহর রহমতেই ছিলো। যার ফলে তুমি মানুষের সাথে কোমল আচরণ করেছো। তুমি যদি রূঢ় প্রকৃতির বা কঠোর হৃদয়ের হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে গিয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেতো; সুতরাং তাঁদের ক্ষমা করো। তাঁদের মাগফেরাতের জন্য দোয়া করো এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁদের সাথে পরামর্শ করতে থাকো। এরপর যখন কোনো বিষয়ে তুমি মনস্থির করে সংকল্পবদ্ধ হবে, তখন আল্লাহর উপর নির্ভর কোরো। আল্লাহ তাঁর উপর নির্ভরকারীদের ভালোবাসেন।’
যখন হেরাগুহায় রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর দূত জিবরীল আলাইহিস সালামকে দেখে তটস্থ হলেন, তখন তিনি কী করবেন না করবেন, সে ব্যাপারে হযরত খাদিজা রা. তাঁকে পরামর্শ দিয়ে আশ্বস্ত করেছিলেন। এমনকি আয়েশা রা.-এর নামে যখন মোনাফেকরা অপবাদ রটায়, তখনও তিনি নানাজনের সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ করতে থেকেছেন। পরামর্শ বা মতামত নেওয়াকে তিনি অতি গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যাপার বলে মনে করতেন, অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তিনি একজন নবী, তাঁর উপর ওহী নাযিল হতো! তদুপরি, এমন ঘটনা অসংখ্য যে, তিনি সাহাবীদের কোনো এক বিষয় করতে নির্দেশ দিলেন, সাহাবাদের কেউ জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, এটা কি আপনার প্রতি আল্লাহর নির্দেশ, নাকি নিজের সিদ্ধান্ত?’ যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, আল্লাহর নির্দেশ, তখন সাহাবারা বিনা বাক্যব্যয়ে তাঁর নির্দেশ মেনে নিতেন; কিন্তু তা যদি না হতো, তাহলে সাহাবারা নিজেদের মত ব্যক্ত করতেন। এই যে সাহাবাদের মধ্যে মত ব্যক্ত করার অভ্যাস রুচি বা পরিবেশ তৈরি হয়েছিলো, তা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণের ফলেই তাঁদের মধ্যে তৈরি হয়েছিলো।
রাসূলে কারীম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের প্রতিটি গুণ এমন, আজকের পৃথিবীতেও আমরা যদি সেই গুণে বিশেষিত হই, তাহলে আমরা উন্নত জীবনের সুফল পাবো। রাসূলের জীবনাদর্শ যে কোনো কালের যে কোনো সময়ের যে কোনো পেশার ও যে কোনো তবকার মানুষের জন্য এমন এক আদর্শ, যা সবসময় আধুনিক, সাম্প্রতিক ও সমকালীন; মূলত তা কালোত্তর বা সকল কালের জন্য যথার্থ।
ঘটনা ও সূত্র : কুরআন—সূরা শুরা, সূরা আলে ইমরান; বুখারী, তবাকাতে ইবনে সাদ