শাশ্বত সত্যের অকুতোভয় বার্তাবাহী

সত্যের প্রকাশে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন এমন অকুতোভয় সাহসী একজন, যাঁর কোনো উপমা কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাঁর সত্যগুলো ছিলো আকাশ ভেঙে পড়ার মতো, অবাকতায় হাঁ হয়ে যাওয়ার মতো, লোকদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য অবলীলায় টেনে আনার মতো, বন্ধুতা-আত্মীয়তা ছিন্ন হয়ে যাওয়ার মতো, বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়বার মতো—কিন্তু আমরা দেখেছি, তাঁর জীবনের সবখানেই ছড়ানো এমন-সব সত্য, যা নিয়ে তাঁকে মুখোমুখি হতে হয়েছে এর সবকিছুর, তবে তিনি টলে যাননি। এই অটলায়মান সত্য সঙ্গে করে তিনি সবসময় দাঁড়িয়েছেন বুক চিতিয়ে স্মিতহাস্যে, কিন্তু অহংয়ের বাড়াবাড়ি নিয়ে নয়; তাঁর সত্য অকুতোভয় ছিলো, পরাক্রমশীল ছিলো, কিন্তু অহংকারী বা কটুকাটব্যে জর্জরিত ছিলো না,—তাঁর সত্য ছিলো স্মিত স্নিগ্ধতায় বিনীত ও সুদৃঢ়। তাঁর সত্য ছিলো মমতার দু কূল ছাপা, তাঁর সত্য ছিলো সাধক মার্গের, তাঁর সত্য ছিলো সততার পূর্ণতায় এতই দীপান্বিত যে, রাতের দিন হওয়া সম্ভব হতে পারতো, হতে পারতো সম্ভব সাগরের নদী বা ঘরের পাশের ছোট্ট জলাধার হওয়া, কিন্তু তাঁর সত্য বিন্দুমাত্র বিচলতায় বিচ্যুত ছিলো না।

বিজ্ঞানের এই সফলতার যুগে, সীমাহীন উৎকর্ষতার এমন দাপুটে সময়ে, যখন তারহীন মুঠোপ্রযুক্তির মাধ্যমে পৃথিবী এসে গেছে নখদর্পণে, সত্যাসত্যের ভেদ ভুলে আমরা মেনে নিয়েছি মানুষের চাঁদে যাওয়ার তথ্যকে, অজস্র অবাকতা ও বিস্ময়ের দুয়ার যখন আমাদের চোখের সামনে প্রতিনিয়ত হাট হয়ে খুলে যাচ্ছে, তখনও যে সত্য অচিন্ত্যনীয়, তখনও যে সত্য অবিশ্বাস্য, তখনও যে সত্য বায়বীয় অর্বাচীনতার দোষে মিথ্যা হতে বাধ্য, সেই আপাত বিপর্যয়কর নিগূঢ় মহান সত্য নিয়ে শুধু একার সঙ্গী হয়ে—ছিলো না তাঁর সাথে কোনো বন্ধু, কোনো পরিজন, কোনো সমর্থক কিংবা এমন কোনো জন, যে তাঁর কথা মানছে না ঠিক কিন্তু সহানুভূতি নিয়ে আগ্রহী হয়ে আছে তাঁর দিকে, —এমন সব আনুকূল্যের বিশাল বিপুল বিয়োগ নিয়ে শুধু আল্লাহর ভরসা মাথায় করে আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে এক সত্য-মানুষ দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন দুঃসাহসিকতায় ভরা কিন্তু সম্পন্নতার বিশ্বাসে মূর্তমান এক সত্য নিয়ে…

এক রাত্রির খণ্ডকালীন পরিসরে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিস্ময়কর এক ভ্রমণ শেষে পৃথিবীর বুকে ফিরলেন। এই বিস্ময়কর অভূতপূর্বতা শুধু শব্দে বলে পরিমাপ করা যায় না। যখন তিনি প্রকাশ করবেন সে ভ্রমণবৃত্তান্ত, তখন বোঝা যাবে কী বিস্ময় পরিগ্রহ করে তিনি ফিরেছেন। যখন তিনি ফিরলেন এই পৃথিবীতে, তাঁর শহর মক্কায়, তখন তাঁর জন্য কোথাও সংবর্ধনার ডালি সেজে নেই, বরং তাঁরই জন্মশহর তাঁর জন্য হয়ে উঠেছে ভয়ংকর প্রতিকূল, সকলেই তাঁর বিরুদ্ধে রক্তচক্ষু নিয়ে গর্জমান।

তিনি জানেন, শুধুমাত্র কথায় ভর-করা নবুওতের যে সত্যের কারণে লোকে তাঁকে জাদুকর বলেছে, মাতাল বেঢপ পাগল বলেছে, কথার চাতুর্য-ছড়ানো চালাক এক কবি বলেছে, তাঁকে স্বজাতির কাছে করে তুলেছে জাতির শত্রু অপাঙক্তেয় আর আত্মীয়তার অমলিন মাধুর্যে কদর্য ভরে দেওয়া নোংরা মানুষ হিসেবে, সেই কাফেররা কোনো দিনও এই তুলনারহিত সত্য মেনে নিতে পারবে না; তাঁকে হতে হবে আরও ঘৃণ্য পরিস্থিতির মুখোমুখি; সব জেনেও তিনি সেই সত্য নিয়ে অবিচল হয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর আদর্শবাদী কোনো বন্ধুর কাছে নয়, তিনি এই ঝঞ্ঝাছড়ানো সত্য নিয়ে দাঁড়ালেন তাদের সামনে, যারা তাঁকে মিথ্যুক বলবে, ঠাট্টা করবে, আরও-আরও কঠিন করে তুলবে তাঁর চলার পথের রাস্তা; কিন্তু সব জেনেও তিনি সববেত তাদের সামনে বললেন, রাতের নির্দিষ্ট একটা সময়ের ভেতর তিনি ভ্রমণ করে এসেছেন জেরুজালেমে অবস্থিত বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে; তারপর সেখান থেকে তিনি একে-একে ভ্রমণ ও প্রত্যক্ষ করেছেন সাত আসমান, সেই জগতের বিস্ময়কর সব আয়োজন, জান্নাত-জাহান্নাম, এমনকি আল্লাহর দিদার।

তিনি অবিচল নির্ভরতায় এসব বললেন জড়তাহীন ভঙ্গিতে অনাড়ষ্ট স্পষ্টতর ভাষায়। এক বায়তুল মোকাদ্দাসের অভিজ্ঞতার বর্ণনাই তাঁকে পাগল সাব্যস্ত করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট ছিলো; কিন্তু তিনি তা করেই ক্ষান্ত হননি। ফল যা হবার তা-ই হয়েছিলো। কাফেররা বিপুল বিদ্রুপে তো ফেটে পড়েছিলোই, এমনকি কিছু নতুন মুসলিম নবীজির এই সত্য ঘোষণায় টালমাটাল হয়ে ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো। কিন্তু যাঁর সত্যের দৃঢ়তা দৃঢ়তার আর-সব তুলনাকেও চুপ করিয়ে দেয়, তিনি তো বিচলিত হন না; সত্য নিয়ে আরও তেজোস্নিগ্ধ হয়ে দাঁড়ান। তিনিও দাঁড়িয়েছিলেন। এক-এক করে সবার মন থেকে সরিয়েছিলেন সংশয়ের দুর্বলতর মেঘগুচ্ছটিকেও।

শত্রুর আসন্ন পরাজয়ে হো-হো-করা পরাক্রান্ত সেনাবাহিনীর তেজের সামনে একাই যুদ্ধ করার ঘোষণা দেওয়ার চেয়েও বিধ্বংসী আর বিপর্যয়কর ছিলো এই সত্য। কিন্তু সত্যের ধ্রুবতা বয়ে-আনা সেই অবাক মানুষ অটল দৃঢ়তায় ভরা এই সত্য নিয়ে সেই বিপর্যয় ও ধ্বংসের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন অকুতোভয়তা ও বিজয়ের বিমিশ্র বৈভব নিয়ে।

ঘটনাসূত্র : সূরা বনী ইসরাইল, তাফসীরে ইবনে কাসির