নবীজিকে লোকে আল-আমিন নামে ডাকতো। এই ডাক তিনি পেয়েছিলেন তাঁর অবিশ্বাস্য সততা আর বিশ্বস্ততার ফলে। তিনি ছিলেন সত্যবাদিতার কিংবদন্তী। মানুষ ভাবতে পারে না, এমন বিষয়কেও তিনি সত্যের এমন গৌরব দিয়েছেন যে, মানুষ বিহ্বল হয়েছে। ইসলামের আগে তো বটেই, ইসলামের পরেও যখন নবীজি তাদের জানি দুশমন, তখনও তারা অত্যন্ত গভীরভাবে আস্থা রাখতেন নবীজির কথায়; তারা স্থিরভাবেই জানতেন, আর যা-ই হোক, মুহাম্মদ মিথ্যা বলতে পারেন না। শুধু যে তিনি সত্য বলতেন, তা-ই নয়, সত্য কথার ধরন-ধারণ কী হবে, সাহাবীদের তিনি সারা জীবন ধরে শিখিয়ে গেছেন। মিথ্যার সামান্যতম লেশ তিনি পছন্দ করতেন না। সাহাবীদের সেই ব্যাপারে সতর্ক এবং নিরুৎসাহিত করতেন। হাসি-ঠাট্টার খাতিরেও মিথ্যাকে তিনি প্রশ্রয় দিতে কঠোরভাবে বারণ করেছেন।
আমের ইবনে রবীয়া যখন ছোট, তখনকার ঘটনা। তিনি বলেন, ‘একবার মা আমাকে ডাকলেন। বললেন, এসো, এলে তোমাকে কিছু দেবো। নবীজি তখন আমাদের ঘরে বসা ছিলেন। তিনি মাকে জিজ্ঞেস করলেন, ওঁকে কী দেবে? মা বললেন, খেজুর দেবো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, মনে রাখবে, ওঁকে যদি কিছু না দাও, তাহলে গুনাহ লেখা হবে।’
ছোটদের কথা শোনানোর বাহানাতেও আমরা যে নানা কথা বলি, সেটাকে তো আমরা কথাই ধরি না; সেটা রাখতে হবে, এমন গুরুত্ব তো আমাদের মনেই আসে না; কিন্তু নবীজি এমনই মনস্তাত্ত্বিকতা বুঝতেন যে, তিনি এ থেকেও একটি শিশুর ঝোঁক মিথ্যার দিকে চলে যেতে পারে বলে বিবেচনা করতেন। আর আদতে তো তা-ই হয়। আমরা বুঝতে পারি না, কিন্তু দেখি, বাচ্চারা আমাদের কথা শুনছে না। আসলে এসবের পেছনে আমাদের অচেতন ওইসব মিথ্যার হাত রয়েছে।
সাদ ইবনে মুয়ায ছিলেন মদীনার লোক। তিনি মক্কা গেলে উমাইয়া ইবনে খলফের বাড়িতে থাকতেন। আবার উমাইয়াও সাদ ইবনে মুয়াযের বাড়িতে থাকতো। ইসলামের আগে থেকেই তারা দুই জনে বন্ধু। একবার সাদ রা. মক্কায় গেলেন। উঠলেন যথারীতি উমাইয়ার বাড়িতে। উমাইয়া তো আর মুসলিম নয়, কিন্তু তখনও অমুসলিমের সাথে বন্ধুতার ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা আসেনি। তাই সাদ রা. উমাইয়ার বাড়িতে। সাদ রা. কাবা তাওয়াফ করতে মনস্থ করলেন। উমাইয়া বললো, ‘কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। দুপুর হলে যখন সব সুনসান হবে, মানুষ উদাস হয়ে পড়বে, তখন তাওয়াফ কোরো।’
সাদ রা. তাওয়াফ শুরু করলেন। এমন সময় কাবাপ্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত হলো আবু জেহেল। সে জিজ্ঞেস করলো, ‘কে এখানে?’ সাদ রা. নিজেকে লুকালেন না। তিনি বললেন, ‘আমি সাদ।’ আবু জেহেল বললো, ‘তোমরা আমাদের দুশমনদের মদীনায় আশ্রয় দিয়ে এখানে তাওয়াফ করতে এসেছো?’ এক কথায় দুই কথায় দুই জনের মধ্যে বচসা শুরু হলো। উমাইয়া এতক্ষণ চুপ থাকলেও সাদ রা.-কে থামিয়ে দিতে চাইলো। বললো, ‘আবুল হিকামের উপর কথা বোলো না, সাদ। সে এই উপত্যকার সরদার।’ সাদ রা. দমলেন না, তিনি আরও তেতে উঠলেন; বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, যদি আমার তাওয়াফে বাধা দাও, তাহলে সিরিয়ায় তোমাদের বাণিজ্যকাফেলা যাওয়া বন্ধ।’ উমাইয়া কিছু না-পেরে আবার একই কথা বললো। সাদ রা. তার কথায় কোনো কর্ণপাত না-করে বললেন, ‘আরে, রাখো তোমার কথা। আমি তো শুনেছি, আল্লাহর রাসূল তোমাকে হত্যা করবেন।’ উমাইয়া যেন তখনই হত্যা হয়ে গেছে। তার সম্বিৎ উড়ে গেলো। আসলেই সে ঠিক শুনেছি কি না বোঝার জন্য জিজ্ঞেস করলো, ‘আমার কথাই বলেছেন মুহাম্মদ?’ সাদ রা. বললেন, ‘হ্যাঁ, তোমার কথাই তিনি বলেছেন।’ শুনে তো উমাইয়ার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেলো তখনই। পাগলের মতো হয়ে গেলো সে। বলতে লাগলো, ‘আল্লাহর কসম, মুহাম্মদ কখনো মিথ্যা বলেন না।’ সে নিজের স্ত্রীর কাছে গেলো। বুঝি ভরসা পেতেই। সব খুলে বললো। তার স্ত্রী বললো, ‘তাহলে তো তোমার রক্ষা নেই। মুহাম্মদ তো কখনো মিথ্যা বলেন না।’
আসলে এটা ছিলো একটি প্রত্যয়। কিন্তু তারা জানতো, রাসূলের কথা মানেই সেটা সত্য হবে। সত্যের ভবিষ্যতের রূপকে যখন তিনি বলবেন, তাও অতীতের হয়ে-যাওয়া ঘটনার মতোই মূর্ত এবং বর্তমানের মতোই ঘটমান। তাদের বিশ্বাসের মতো করেই সকল সত্যের মতো এই সত্যও ফলেছিলো। উমাইয়া খুব সহজ আঘাতে রাসূলের হাতেই নিহত হয়েছিলো। এরকমই ছিলো তাঁর সত্যের ধ্রুবময়তা।
ঘটনাসূত্র : সহীহ বুখারী।